হায়দ্রাবাদকে সাম্রাজ্যে হিসেবে গড়ে তোলার পিছনে যার অবদান তিনি হলেন মির কামাল উদ্দিন চিন কিলিচ খাঁ। চীন কিলিচ খান মুঘল দরবারে তুরানি গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন(সমরখন্দ)। উত্তর ভারতের রাজনৈতিক গন্ডগোলের কারণে তিনি দক্ষিণ ভারতে চলে আসেন। 1713 সালে ফারুকশিয়ার তাকে দাক্ষিণাত্য সুবার সুবাদার করেন এবং “নিজাম উল মুলক” উপাধি দিয়েছিলেন। চিন কিলিচ সামরিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে হায়দ্রাবাদকে প্রসারিত করেন এবং ভিত্তি দান করেন। মোগলদের দুর্বলতার সুযোগে এবং অন্তর্দ্বন্দ্বের সময় মুঘল বাদশাহ মোহাম্মদ শাহের এক অনুগামীকে  পরাজিত করে 1724 সালে তিনি স্বাধীন হায়দ্রাবাদ রাজ্যের পত্তন করেন। মোহাম্মদ শাহ তাকে সুবাদার হিসেবে মেনে নেন এবং তাকে আসফ ঝা উপাধি দেন। এভাবে 1724 থেকে স্বাধীন হায়দ্রাবাদ রাজ্যের নিজাম শাহী শুরু হয় এবং  1948 পর্যন্ত এটি চলে। রাজ্যটি 1798 সালে প্রথম অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির স্বাক্ষর করে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে মিত্রতা করে। প্রতিবশী মারাঠা এবং মহীশূরের সঙ্গেও নিজামের লড়াই চলেছিল। একসময় মারাঠারা নিজামকে দু-দুটি যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন এবং তারা এখান থেকে কর আদায়ের অধিকার পেয়েছিলেন। 

বিভিন্ন নিজামদের সময়ে বিশেষ ভাবে হায়দ্রাবাদের উন্নতি হয়েছে। যেমন তৃতীয় নিজাম সেকেন্দ্রাবাদ শহরের পত্তন করেন। পঞ্চম নিজামের সময়ে তার প্রধানমন্ত্রীর সালার জং রাজ্যটির প্রশাসনিক সংস্কার করেন। ষষ্ঠ নিজামের সময় এখানে রেলওয়ে এবং শিল্পের বিস্তার ঘটে। সপ্তম নিজাম যার সময়টা আমাদের বিশেষ আলোচিত কারণ হায়দ্রাবাদ ভারত অন্তর্ভুক্তির সময়  সময় উনি ছিলেন হায়দ্রাবাদের শাসক।  সপ্তম নিজাম মির ওসমান আলি খানের শসময়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে কিন্তু হায়দ্রাবাদের উন্নতি হয়েছিল। অনেক বিখ্যাত মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা এখানে জড়ো হয়েছিলেন। ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়,  হায়দ্রাবাদ স্টেট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, প্রযুক্তিগত এবং আধুনিকীকরণ ঘটেছিল।  নিজাম টাইম পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী 1937 সালে  পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি ছিলেন। 

এ রাজ্যটির বিশেষ কতগুলো বৈশিষ্ট্য ছিল প্রথমত নিজস্ব রেল ব্যবস্থা, যাতায়াত ব্যবস্থা, এয়ারপোর্ট, এয়ারওয়েজ এর মালিক ছিলেন নিজাম। 

এটি একমাত্র ভারতীয় রাজ্য যার নিজস্ব মুদ্রা ছিল। এখানে পোস্টাল, টেলিকম, রেডিও ব্যবস্থাও ছিল। 

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এখানকার শাসক মুসলিম কিন্তু তার বেশির ভাগ প্রজা ছিলেন হিন্দু। 1941 এর জনগণনা অনুযায়ী এখানে 85%  হিন্দু বাস করতেন। 

কিন্তু লক্ষণীয় যে, প্রশাসনিক, পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীতে হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব কিন্তু খুব কম ছিল। যেমন একটা উদাহরণ 1765 জন 

আর্মি অফিসার এর মধ্যে 1268 জন ছিলেন মুসলিম। 600 টাকার ওপর বেতন পাওয়া অপিসার হিন্দুর সংখ্যা মাত্র পাঁচজন। নিজাম এবং তার অভিজাত ওদের কাছে জমির পরিমাণ ছিল 40 শতাংশ। 

এখানে 10 শতাংশ মানুষ উর্দুতে কথা বলতেন, 48 শতাংশ মানুষ তেলেগুতে, 26 শতাংশ মানুষ মারাঠা এবং 12% কন্নড়। বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো যে রাজ্যটির নিজস্ব পররাষ্ট্র নীতি ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এ রাষ্ট্রটি সম্পর্ক রাখত। ভারত স্বাধীনতার সময় দিল্লিতে হায়দ্রাবাদ হাউস নামে তারা দূতাবাস করেছিল। 

হায়দ্রাবাদ রাজ্যটিতে ক্রমশ  ধর্মতান্ত্রিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। নিজামের প্রশাসন থেকে অবসরপ্রাপ্ত একজন অফিসার মোহাম্মদ নওয়াজ খান 1926 সালে “মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন” ( MIM)  নামে একটি দল বা গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন।   দলের উদ্দেশ্য ছিল  নিজামের স্বপক্ষে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং এখানে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করে হিন্দু জনসংখ্যা যথাসম্ভব কমান। 

  1947 সালে ধর্মের ভিত্তিতে  ভারত যখন ভাগ হলো তখন  ভারত স্বাধীনতা আইনে দেশীয় রাজ্যগুলি সম্পর্কে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। 

রাজ্য গুলি সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে তারা ইচ্ছা করলে স্বাধীন থাকতে পারে অথবা তারা পাকিস্তান বা ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের যোগদান করতে পারে।    1947 সালের 11 জুন নিজাম একটি ঘোষণা দিলেন যে তিনি গণপরিষদে যোগদান করবেন না এবং তিনি পাকিস্তান বা ভারত যুক্তরাষ্ট্র কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হবেন না অর্থাৎ তিনি স্বাধীন থাকতে চাইলেন।নিজাম ওসমান আলী ব্রিটিশদের কাছে অনুরোধ করেছিলেন যাতে তিনি স্বাধীন নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করে,  কমনওয়েলথের সদস্য থাকতে পারেন। ভারত শাসন আইন আইন অনুযায়ী স্ট্যান্ড স্টিল এগ্রিমেন্ট অথবা ভারত অন্তর্ভুক্তিতে সামিল হতে বলা হলে হায়দ্রাবাদ কয়েকমাস সময় নেয়। শেষ পর্যন্ত হায়দ্রাবাদ  স্ট্যান্ড স্টিল এগ্রিমিন্টে স্বাক্ষর করে (২৯ নভে,১৯৪৭) এই অনুযায়ী এখানে স্ট্যাটাস কো বা যথা পূর্বং অবস্থা বজায় থাকবে। এক বছর এখানে কোনো সামরিক অভিযান করা হবে না।  স্ট্যান্ডস্টিল এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী হায়দ্রাবাদের বিদেশনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে ভারত কিন্তু কোন সেনাবাহিনী রাখা যাবে না এবং সেকেন্দ্রাবাদ থেকে সেনাবাহিনী তুলে নেওয়া হবে। 

হায়দ্রাবাদ স্ট্যান্ড স্টিল এগ্রিমেন্ট সই করার সিদ্ধান্ত  নিলে  (অক্টোবর ১৯৪৭) আলিগড়ি কাশিম রিজভী নেতৃত্বে এখানে রাজাকার বাহিনী হায়দ্রাবাদ  প্রধান মন্ত্রীর বাড়ির সামনে  বিক্ষোভ প্রদর্শন করে যাতে এই এগ্রিমেন্টের সই না করা হয়। এই রিজভি আলিগড়ের পড়া মানুষ।মিম নেতা। নিজামের নিকট থেকে ইঙ্গিত পেয়ে এবং অধিকার পেয়ে তিনি নিজামকে  পরিচালিত করতে থাকে এবং ক্ষমতা  অপব্যবহার  করেন।

রাজাকাররা পাকিস্তানে  যোগদানের পক্ষপাতী ছিল। রিজভির মতে হায়দ্রাবাদ মুসলিম রাষ্ট্র এবং মুসলিম রাষ্ট্র যুদ্ধ ও বিজয়ের উপর নির্ভরশীল। তাই তিনি জেহাদী সংগঠিত সশস্ত্র   মিলিশিয়া গঠন৷ করে  কাজে লাগান। কমিউনিস্টরা রাজাকারদের প্রতি  সহানুভূতিশীল ছিল। 

হায়দ্রাবাদ স্ট্যান্ড স্টিল এগ্রিমেন্ট এর নিয়ম লঙ্ঘন করে পাকিস্তানের কাছ থেকে 15 পাউন্ড লোন নেয় এবং তার আধাসামরিক বাহিনী কে মজবুত করার চেষ্টা করে। হায়দ্রাবাদ এর পক্ষ থেকে বলা হয় যে ভারত অর্থনৈতিক অবরোধ করছে। ভারতের পক্ষে হায়দ্রাবাদের বহু জাতি ধর্ম অধ্যুষিত রাজ্যে স্বাধীন বিদেশনীতি,   পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, রাজাকারদের উপস্থিতি এই বিষয়গুলি নব্য স্বাধীন ভারতের নিরাপত্তা পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করে। 1937-  নাগাদ মিম এবং মুসলিম লীগের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয় এবং তারা হায়দ্রাবাদকে  স্বাধীন ইসলামিক রাষ্ট্র করতে চায়। যদিও আর্য সমাজে ও হিন্দু মহাসভা   হিন্দুদের পক্ষে দাঁড়ায়। এখানে হিন্দুদের মধ্যে জনমত তৈরি হয় তারা ভারতে  যোগদানের পক্ষে। হায়দরাবাদ রাজ্যের হিন্দু  মুসলিম সম্পর্ক ও ভারতের চাপ লক্ষ্য করি সেখানে গণবিদ্রোহ হতে পারে ভেবে নিজাম উগ্রবাদী স্বেচ্ছাসেবী  সশস্ত্র বাহিনী গঠনে সহায়তা করে যাদের রাজাকার বলা হয়। রাজাকারদের সংখ্যা প্রায় দুই লক্ষের মত। তারা অস্ত্রে শাস্ত্রে সজ্জিত হয়। রাজাকার ছাড়াও পাঠান আরবি, দেনকর ইত্যাদি ইসলামিক গ্রুপ করে এখানে অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে।   রাজাকার এবং অন্যান্য ইসলামিক বাহিনীগুলি  সমস্ত হায়দ্রাবাদের গ্রাম-শহরে  সক্রিয় হয়ে ওঠে। হিন্দুদের হত্যা, মহিলাদের ধর্ষণ, অপহরণ,বাড়ি পোড়ানো, লুঠপাট, অমুসলিমদের সম্পত্তি  দখল করা, সন্ত্রাস তৈরি করা  হয়। রাজাকারদের অত্যাচারে বহু হিন্দু অন্যান্য রাজ্যে আশ্রয় নেয়।একমাত্র মধ্যপ্রদেশের প্রায় 40,000 উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছিলেন।ভারতপন্থী যে সমস্ত মুসলিমদের রাজাকাররা তাদের ভয় দেখায় একজন  মুসলিম সাংবাদিককে হত্যা করে। হায়দ্রাবাদ কংগ্রেসকে  নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

হায়দ্রাবাদের বিদেশমন্ত্রী একুশে আগস্ট 1948  জাতিসংঘে  35a ধারা অনুযায়ী আবেদন করেন। হায়দ্রাবাদের   আইন সভায় সেপ্টেম্বরে হায়দ্রাবাদের প্রধানমন্ত্রী  জানান যে একটি  কমিটি  জাতিসংঘে পাঠানো হবে।  এ রকম অবস্থায় নেহেরু হায়দ্রাবাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চেয়েছিলেন এবং তিনি হয়তো ভয় পেয়েছিলেন যে কাশ্মীরের মতো পাকিস্তান হায়দ্রাবাদের হস্তক্ষেপ করবে কিন্তু পাকিস্তানের সে শক্তি ছিলনা সেটা বোঝার দূরদর্শিতা তার চিল না।  তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভ ভাই প্যাটেল  এখানে পুলিশ একশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, সেই অনুযায়ী ভারতীয় সেনাবাহিনী জয়ন্ত রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে “অপারেশন পোলো” শুরু করে। 13 সেপ্টেম্বর 1948 চারিদিক থেকে হায়দ্রাবাদ কে ঘিরে ফেলা হয়।১৭ ই সেপ্টেম্বর হায়দ্রাবাদ আত্মসমর্পণ কর।   নিজামের প্রধানমন্ত্রী এবং কাশিম রিজভীকে গ্রেফতার করা হয়।  

22 শে সেপ্টেম্বর 1948 নিজাম  জাতিসংঘ থেকে তাঁর অভিযোগ তুলে নেন। হায়দ্রাবাদ ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এভাবে হায়দ্রাবাদের মুক্তি ঘটে। সুন্দরলাল কমিশনের মতে 25 থেকে 40 হাজার মানুষ এখানে প্রাণ হারান। মিম নিষিদ্ধ ঘোষণা হল।  যদিও কংগ্রেস সরকার 1957 তে অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনকে ছাড় দেয়। যার বর্তমান  নেতা আসা উদ্দিন ওয়েসি অস্থিরতা তৈরি করে চলেছে। কাসিম রিজভির  জেল হয়েছিল। তাকে  48 ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হলে তিনি পাকিস্তানে আশ্রয় নেন। 

স্বাধীনতা-উত্তরকালে ভারতের   রাজনৈতিক ঐক্য ও পুনর্গঠন এর ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভ ভাই প্যাটেল এর ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত। লক্ষ লক্ষ হিন্দু উদ্বাস্তু দশা থেকে   মুক্তি পেল। ভারতবর্ষের নিরাপত্তা ও অখণ্ড তার জন্য হায়দ্রাবাদ ভারতে অন্তর্ভুক্তির যে বলিষ্ঠতা প্রয়োজন ছিল তার স্বরাস্ট্রমন্ত্রী প্যাটেল দেখিয়েছিলেন। লক্ষণীয় হায়দ্রাবাদের পরাধীনতা শুরু হয়েছিল সমরখন্দ থেকে আসা লোকের হাতে, আলীগড়ে পড়া মানুষ রিজভী ও তার নৃশংস জেহাদী বাহিনীর এখানে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল, আর শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান  গিয়ে রিজভী আশ্রয় নিলেন। তাই সমরখন্দে যে ইতিহাস শুরু হয়েছিল আলীগড় হয়ে পাকিস্তানে তা শেষ হলো।

মনোরঞ্জন জোদ্দার 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.