পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক কৃষ্ণনাথ কলেজের অবলুপ্তি প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য নিচে দিলাম। বন্ধুরা মতামত জানালে বাধিত হব।

         ||একটি স্বপ্নের সমাধি।।

              ।বিনয়ভূষণ দাশ ।

মাত্রই উনিশ বছর বয়সে এক সদ্যযুবক এমন এক স্বপ্ন দেখলেন যা তাঁর যুগের সমসাময়িক মানুষের কাছ এক অবিশ্বাস্য কল্পনা বলে মনে হয়েছিল।তাঁর স্বল্পায়ু জীবনের সাথে হয়ত মিল খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলার রেনেসাঁসের অন্যতম প্রাণপুরুষ, অকালমৃত হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও-এর স্বল্পায়ু জীবন ও কাজের সাথে। কিন্তু বাংলার সমস্ত কিছুই যে বড্ড কলকাতাকেন্দ্রিক! সুতরাং তাঁর জীবন নিয়ে আলোচনা নেই। তিনি, কাশিমবাজার রাজপরিবারের সন্তান রাজা কৃষ্ণনাথ রায়।তিনি ছিলেন তাঁর যুগের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। মাত্রই বাইশ বছর ছিল তাঁর জীবৎকাল। বাংলার রেনেসাঁসের মূল সুর আর বিদ্যাশিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। বাস্তবিক ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দেই বহরমপুর-কাশিমবাজারে একটি মহাবিদ্যালয়( কলেজ) স্থাপনের কথা তাঁর চিন্তায় আসে। এই চিন্তা অনুযায়ী তিনি ৭ জানুয়ারি ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে একটি উইল করেন।এই উইলে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হয়েছে প্রস্তাবিত কলেজের খরচ-খরচার বিষয়,শিক্ষাদান পদ্ধতি, অধ্যাপক নিয়োগ, পৃষ্ঠপোষক কারা হবেন সে বিষয়, প্রস্তাবিত মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের বিষয়সমূহ, কোথায় মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে, কি নাম হবে ইত্যাদি খুঁটিনাটি সমস্ত বিষয়।তিনি ইংরাজিতে সম্পাদিত তাঁর এই উইলে উল্লেখ করেছিলেন,‘দি সেম ( দি কলেজ) শ্যাল বি নেমড রাজা কৃষ্টনাথ’স কলেজ’। এরপরে আরও তিনটি বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কৃষ্ণনাথের মনে আরও সদর্থক পরিবর্তন হয়েছে।রাজা কৃষ্ণনাথের বন্ধু, নবীনকৃষ্ণ মিত্র তাঁর ‘ এফিডেভিটে’ উল্লেখ করেছেন , কৃষ্ণনাথ তাঁকে তাঁর উইলে কিছু পরিবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আর প্রার্থিত পরিবর্তনের একটি হল, পূর্বোক্ত উইলে কলেজের স্থলে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটি লিপিবদ্ধ করা।একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের চিন্তা তাঁর মনকে এতটাই অধিকার করে ছিল যে, তাঁর দুঃখজনক আত্মহত্যার ঠিক আগের দিন, যন্ত্রণাকাতর মুহূর্তেও তা ভুলতে পারেননি। তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর আগের দিন, ৩০শে অক্টোবর, ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর দ্বিতীয় উইল সম্পাদন করে যান। ভারতে সরকারী মহলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা চিন্তাভাবনা করার বহু আগেই, মৃত্যুর আগের দিন করা উইলে তিনি উচ্চতর বিদ্যাশিক্ষার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যবস্থা করে যান।এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানে একটি হাসপাতাল স্থাপনের সংস্থানও করে যান ওই উইলে। ওই হাসপাতালে একজন ইংরাজ ডাক্তার এবং একজন উপযুক্ত এদেশীয় ডাক্তার নিযুক্তির কথাও উল্লেখ করেন ওই উইলে। তাঁর প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও তিনি উল্লেখ করে যান। ওই উইলে তিনি লেখেন, ‘ শ্যাল বি অ্যাপ্লায়েড টু দি এসটাব্লিশমেন্ট অফ এ কলেজ দ্যাট ইজ এ স্কুল ইন মাই নেম দ্যাট ইজ টু বি এনটাইটেলড‘ দি কৃষ্ণনাথ’স ইউনিভারসিটি অফ বানজেটিয়া।‘ এটা এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের তের বৎসর আগের ঘটনা। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে, মহাবিদ্রোহের বৎসরে কলকাতা, মুম্বাই এবং চেন্নাইয়ে স্থাপিত হয় ভারতের প্রথম তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু রাজা কৃষ্ণনাথের সাধ অপূর্ণই থেকে যায়। তাঁর সাধের বিশ্ববিদ্যালয়, যেটির হবার কথা ছিল ভারত তথা এশিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু স্থাপিত হতে পারেনি এই বিষয়ে তাঁর সুস্পষ্ট উইল থাকা সত্বেও।

১৮৪৪-৪৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সরকার প্রতিটি জেলায় একটি করে জেলা স্কুল এবং প্রতি পাঁচটি জেলায় একটি করে কেন্দ্রীয় মহাবিদ্যালয় স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করে। সেই অনুযায়ী পাঁচটি কেন্দ্রীয় মহাবিদ্যালয় স্থাপনের জন্য স্থান নির্ধারিত হয় মুর্শিদাবাদ, চট্টগ্রাম, কটক, কৃষ্ণনগর এবং ভাগলপুরে । বাংলা সরকারের প্রস্তাবটি ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার অনুমোদন করে। সেই অনুযায়ী ১৮৫৩ এর জুনে সরকার বহরমপুর অথবা মুর্শিদাবাদে কলেজটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই বৎসরের, অর্থাৎ ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর প্রস্তাবিত কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়, নাম দেওয়া হয় ‘বহরমপুর কলেজ’। কলেজটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত হলেও শেষে কাশিমবাজার রাজ পরিবারের দান করা একুশ বিঘা আট কাঠা নয় ছটাক জমিতে স্থায়ী কলেজভবন গড়ে ওঠে।রাজা কৃষ্ণনাথের বিধবা মহারানী স্বর্ণময়ী এবং তাঁর ভাগ্নে মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর দান করা জমিতে, তাঁদেরই অর্থানুকূল্যে এবং বদান্যতায় মহাবিদ্যালয়টি প্রাণ ফিরে পায়।একসময় সরকার কলেজটি বন্ধ করার প্রস্তাব করলে মহারানী স্বর্ণময়ী এগিয়ে এসে কলেজটি বন্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করেন।মহারানী স্বর্ণময়ী প্রতি বছর বারো হাজার টাকা দিতে প্রতিশ্রুত হন, কিন্তু দেখা যায় বাস্তবে তিনি বৎসরে ১৬০০০ টাকা করে দিয়েছিলেন। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে রানী স্বর্ণময়ী কলেজটির স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি ‘এনডাওমেন্ট ফান্ড’ খোলার প্রস্তাব করেন যা থেকে কলেজ পরিচালনায় কুড়ি হাজার টাকা করে ব্যয় করা হবে। আর এরই সাথে কলেজটির নাম ‘ বহরমপুর স্বর্ণময়ী কলেজ’ রাখার প্রস্তাব করা হয়। যদিও প্রস্তাবটি বাস্তবে রূপায়িত হয়নি।১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মহারাণী স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর পরে তাঁর ভাগিনেয় মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর উপর কলেজটির দেখভালের দায়িত্ব বর্তায়।মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত পূর্বসূরি রাজা কৃষ্ণনাথের স্মৃতি স্থায়ী করে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সলিসিটর ওয়াটকিন্স অ্যান্ড কোংএর মাধ্যমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন কলেজটির নাম পরিবর্তন করে ‘কৃষ্ণনাথ কলেজ’ রাখার জন্য। সেই অনুযায়ী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯০২ এর মিটিং এ কলেজের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ওই বৎসরই কলেজের নাম হয় ‘কৃষ্ণনাথ কলেজ’। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারে পরের বৎসর নামটি তালিকাভুক্ত করা হয়। এরপরে কলেজটির যাবতীয় উন্নতি ও ব্যবস্থাপনা দেখভাল করেছেন কাশিমবাজার রাজপরিবারের মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র ও তাঁর পুত্র মহারাজা শ্রীশচন্দ্র নন্দী। তাঁরা কলেজটির উন্নতিকল্পে ধারাবাহিকভাবে দান করে গেছেন। পরবর্তীকালে, মহারাজকুমার সোমেন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সময়ে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়, তিনি বামফ্রন্ট শাসনকালে ‘বোর্ড অফ ম্যানেজমেন্টের’ দায়িত্ব ছেড়ে দেন।কলেজটি ১৬৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী এবং দেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাদান কেন্দ্র। এই কলেজের সাথে ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে যুক্ত ছিলেন বাংলার অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব |১৯০২ খ্রিস্টাব্দে নাম পরিবর্তনের পরেও ১১৯ বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।

২০১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজ্য সরকার ‘মুর্শিদাবাদ ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট, ২০১৮’ আইন পাশ করেছে এবং সম্প্রতি রাজ্য শিক্ষা দফতর ঘোষিত উপাচার্যকে নির্দেশ দিয়েছে ছাত্র ভর্তি প্রক্রিয়া ও তারপরে পঠনপাঠন শুরু করতে। শিক্ষা দফতরের এই নির্দেশের ফলে কৃষ্ণনাথ কলেজের অবলুপ্তি ঘটছে। মুর্শিদাবাদ জেলার সাধারণ মানুষ এবং জেলার শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ বিভিন্নভাবে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে, ১৬৮ বৎসরের পূরানো কৃষ্ণনাথ কলেজকে উন্নীত করে ‘ কৃষ্ণনাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ গঠন করা হোক।তাঁরা এজন্য বহরমপুরে একটি সেমিনার করেছে; নানা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছে সরকারের কাছে। রাজ্যে যে সমস্ত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়েছে সেগুলির নাম কিন্তু পরিবর্তন করা হয়নি, পুরনো নামই রয়েছে । রয়েছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি; আবার ব্যক্তিনামেও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেমন রবীন্দ্রভারতী, বিদ্যাসাগর, সিধু-কানহু-বিরসা, কাজী নজরুল, পঞ্চানন বার্মা ইত্যাদি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে কৃষ্ণনাথ কলেজটি ‘ডিজল্ভড’ (Dissolved) বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, কৃষ্ণনাথ কলেজের জমি, বাড়িতেই নতুন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠনপাঠন হবে।একজন বাইশ বছর বয়সের যুবকের যুগন্ধর এক স্বপ্নের এইভাবে সমাধি ঘটবে ? জেলার মানুষের যুক্তিগ্রাহ্য অনুভুতি ও আবেদনকে অগ্রাহ্য করে একটা ১৬৮ বৎসরের ঐতিহ্যকে এভাবে নষ্ট করে দেওয়া হল কেন ?এমন উদাহরণ আর আছে কি দেশে ? পুনরায় কি ফিরিয়ে আনা যায় না কৃষ্ণনাথের নাম ?মুর্শিদাবাদের মানুষের আবেগ এবং কৃষ্ণনাথের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কি ‘ কৃষ্ণনাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ করা যায় না ? রাজ্য শিক্ষাদফতর একটু ভাবুন না !

লেখক : ইতিহাস গবেষক ও প্রাবন্ধিক | কৃষ্ণনাথ কলেজের অর্থনীতি বিভাগের ( 1974) প্রাক্তন ছাত্র |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.