“বিপত্তারিণী পুজো কি এখনও যৌক্তিক” নামক শীর্ষে সনাতনী বিশ্বাস তথা সনাতনীদের ,নানান কুতর্কের মাধ্যমে অপরাধ বোধে , হীনমন্যতায় নিমজ্জিত রাখার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রয়াসকে ইন্ধন দেয়া হয়েছে – এই সকল লেখনী ও প্রচারের একটাই উদ্দেশ্য থাকে কোটি কোটি হিন্দুদের বিচারধারা, বিশ্বাসের গোড়ায় আঘাত করা

গত ৩০ আষাঢ় ১৪২৮, ইং ১৫ জুলাই ২০২১ “বিপত্তারিণী পুজো কি এখনও যৌক্তিক” নামক শীর্ষে সনাতনী বিশ্বাস তথা সনাতনীদের ,নানান কুতর্কের মাধ্যমে অপরাধ বোধে , হীনমন্যতায় নিমজ্জিত রাখার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রয়াসকে ইন্ধন দেয়া হয়েছে। এই সকল লেখনী ও প্রচারের একটাই উদ্দেশ্য থাকে কোটি কোটি হিন্দুদের বিচারধারা, বিশ্বাসের গোড়ায় আঘাত করা। অদ্ভুত ভাবে এই লেখনীতে নানান স্ববিরোধী যুক্তি খাড়া করা হয়েছে ,
প্রথমত লেখক প্রশ্ন করেছেন ” আচ্ছা সত্যই কি বিপত্তারিণী বিপদ তাড়ায় না বাড়ায় ?”, এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন প্রত্যেক হিন্দুর কাছে , সমাজের কাছে। যদিও বিজ্ঞানের কপিরাইট ব্যবস্থা পাশ্চাত্যের সৃষ্ট, ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের ধারণা সমগ্র পৃথিবীর কল্যাণের জন্য । তাই তার উপর কোন ব্যক্তি বিশেষের অধিকার থাকে না। তবুও প্রশ্ন বিজ্ঞানের প্রতিনিধি হয়ে সনাতন সমাজকে করেছেন বিধায় উত্তর সমাজ থেকেই আসবে। এবং তা হল, যে ভিড়ের তর্ক দিলেন সেই ভীড় তো গত নির্বাচনে কোভিডের মধ্যে ভরপুর ভাবে হল , তাহলে কি ভারতীয় গণতন্ত্রে নির্বাচন বিপদজনক ?
দ্বিতীয়ত বললেন কাল্পনিক গল্পের এক কাল্পনিক চরিত্র দেবী দুর্গার, উত্তরে বলি- দেবী দুর্গার বর্ণনা মাহাত্ম্য-মৎস্য পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ , কালিকাপুরাণ ও দেবী ভাগবতে উল্লেখ আছে। যার ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য গুরু শিষ্য পরম্পরায় তার অভ্যন্তরীণ গূঢ় অর্থ বুঝতে হয়, কারণ ভারতে পুরাণ রচনার নির্দিষ্ট শৈলি আছে , যা আক্ষরিক নয় বরঞ্চ সাংকেতিক । যার সত্যাসত্য উদঘাটনে বাঙলারই শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ, সাধক বামাক্ষ্যাপা সহ নানা সাধক পণ্ডিত যুগে যুগে প্রাণপাত করেছেন।
এবার লেখকের কাছে প্রশ্ন পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সবকিছুই কি সনাতন বা সদাসত্য , কখনো তা খন্ডণ হয় না ? হয় নানা আবিস্কার পরবর্তী তে খন্ডণ হয়। নতুন মত সিদ্ধ হয়। ভারতে সেই বিজ্ঞানের ধারা অতি প্রাচীন ঋষি কণাদের বৈশেষিক সূত্র অণু পরমাণুর ধারণা দেয় , তাও পাশ্চাত্যের আগে , সতপথ ব্রহ্ম ও সুল্বসূত্র , আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্কর, বরাহমিহির প্রাচীন গণিত শাস্ত্রের মুখ্য চরিত্র। কিন্তু ভারতবর্ষ কখনো বিদ্যা বিজ্ঞানকে কপিরাইটের মাধ্যমে কুক্ষিগত করেনি। চরক, শুশ্রুত যখন চিকিৎসা শাস্ত্রে অক্ষয় অবদান রাখছেন। নাগার্জুণের রস রত্ন , আরোগ্য মঞ্জরী, যোগসার , বাগভট্টের রসরত্নসমুচ্চ্যা, গোবিন্দাচার্য, যশোধর, রামচন্দ্র , সোমদেব আদি ঋষিরা রসায়ন কে চিরতরে সমৃদ্ধ করেছেন। এখন বলতে গেলে হাজার হাজার ঋষি সহস্রাধিক বিজ্ঞান শাস্ত্রের উল্লেখ করতে হয় ।
কিন্ত তারা কপিরাইট বা পেটেন্ট করেননি , পাশ্চাত্যের পেটেন্ট ব্যবসার গল্প অনেকেই জানেন। তাতে ভারতের জ্ঞান বহু ক্ষেত্রে চুরিও হয়েছে, তাতে আক্ষেপ নেই কারণ ভারতবর্ষ জ্ঞানকে বিজ্ঞানকে ব্যক্তিসম্পত্তি ভাবেনি কখনো।
প্রকৃত অর্থে ভারতের রান্নাঘর গুলিতে আজো মশলা ও শাকের আকারে বহু বহু সঞ্জীবনী ঔষধ আছে , প্রতিদিন আমরা না জেনেই ব্যবহার করি । তেমনই লোকাচার ও পূজার স্থলে ও পদ্ধতিতে এমন বহু জনকল্যাণমূলক অভ্যাস ও নিয়ম নিহিত আছে , যোগ ও প্রাণায়মের মত অভ্যাস আছে। শুধু মাত্র কিছু অসাবধান ব্যক্তিদের কোভিড বিধি মাথায় না রেখে ভীড় করার জন্য সনাতনী মান্যতাকে প্রশ্ন করা আসলে সনাতনীদের হীনমন্যতায়, ও অপরাধ বোধে ফেলার কৌশল।
.

পরবর্তীতে লেখক লিখছেন মান্যতা গুলির উদ্দেশ্যে যে ” এসবের মধ্যে কোন যুক্তি নেই, কোন বিজ্ঞান নেই, এসবের মধ্যে কুশিক্ষা, অন্ধবিশ্বাস, অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কার ,
আমি আগেই বলেছি এর যৌক্তিকতা ও সনাতন সমাজের বিরাট বটবৃক্ষ সমান অবদানের কথা । সৃষ্টির অধিকাংশ আবিস্কার যেখানে প্রকৃত অর্থে ভারতের দান । তবে কি সনাতনীদের নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গে মতানুসারে সার্টিফায়েড ধর্মাচরণ করতে হবে, আজ এরা বিপত্তারিণী নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, দুর্গতি নাশিনী দুর্গা কে নিয়েও । ভারতবর্ষের সনাতন সভ্যতা জ্ঞান ,বিজ্ঞান ও ধর্ম কে এক আকার করে রেখেছে ,যাতে মানুষ একটির সান্নিধ্যে গেলে অন্যটি বাদ না পড়ে। আশা করি বাঙালি জাতি এদের নিশ্চিত ক্ষমা করবে না। কারণ মা দুর্গা বাঙলার পরিচয়, সনাতন সভ্যতার প্রতীক । এই বিশেষ উদ্দেশ্য প্রাণোদিত ব্যক্তিবর্গ শুধুই বিজ্ঞানের আড়ালে সনাতনী বিশ্বাসকেই প্রশ্ন করে । কিন্তু বিশেষ কোন উৎসবের সময় যখন বাঙলার ওলি গলি হাড় মাংস, চামড়া , নাড়িভুঁড়ির ঢিবিতে পরিনত হয় ,তখন প্রশ্ন করা হয় না , যখন বাঙলায় উৎসবের নামে রক্তের নদী বয় প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন করেনা কখনোই, ইংরাজী নববর্ষ উদযাপনের সময় সমগ্র পৃথিবীতে আলোর উৎসবের নামে পরিবেশ দূষণে চুপ থাকেন, চুপ থাকেন উৎসবের নামে পৃথিবী জুড়ে গাছ কাটার সময়। তখন প্রশ্ন আসে না । তার কারণ উদ্দেশ্য শুধু সনাতনীদের মস্তিস্কে হীনমন্যতা ও অপরাধবোধ ঢোকানো। অপরাধবোধে কোন জাতিকে ভোগালে অনেক অসাধ্য সাধন হয়। নেটিভ আমেরিকান, নেটিভ অস্ট্রেলিয়ানরা আজ শেষ হতে যায় ,তার কারণ – নিজেরই অস্তিত্ব থেকে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী দূরে করা হয়েছে, কারণ ভারতবর্ষই পৃথিবীতে একমাত্র স্থান যেখানে স্বতন্ত্র ধর্মশাস্ত্র, শিক্ষা, দর্শন, ইতিহাস, গণিত, চিকিৎসা, রসায়ন, স্থাপত্য টিকে আছে । টিকে আছে সনাতনী আচার, ব্যবহার, সনাতনী ধর্মাচারণে , আর এই বিষয়টা বৈশ্বিক বাজারের ক্ষেত্রে মূলত একটি চ্যালেঞ্জ , কারণ নানান উপায় করেও ভারতের সভ্যতাকে নষ্ট না করতে পারলে পাশ্চাত্যের কাঙ্খিত লক্ষ পূর্ণ হবে না। ব্যবসায়িক, ধার্মিক, ঐতিহাসিক সমস্ত ক্ষেত্রেই।
ভারতবর্ষ জ্ঞানের অপর নাম । তাই ভারতের সনাতন সভ্যতা আজও বিরাজমান। আর সেটা অনেক মানুষের চোখের বালি বইকি । এই সনাতন সভ্যতার জন্যই আজ ভারতকে পাশ্চাত্যের কলোনি করে রাখা যায়নি। নিও কলোনি করার চক্রান্ত স্বরূপ ভারতের সনাতনীদের তাদেরই স্বরূপ, কীর্তি, যশস্বী ইতিহাস থেকে একটু একটু করে দূরে করা হয়েছে , এখনো হচ্ছে।
পরিশেষে মা এবং মহাদেব কে ধন্যবাদ যে সনাতন সমাজের বিপদরা নিজেরাই যেন প্রকট হন সময়ে সময়ে, নইলে আমরা বুঝব না যে সনাতনী সমাজ বিপদমুক্ত নয়, ভারতীয় সংবিধানের ধারা ২৫-২৮ যতই নিশ্চয়তা দিক, সনাতনী সমাজের স্বতন্ত্রতা নিশ্চিত না হলে সমাজ কখনোই বিপদমুক্ত নয়।
.
.
সংগৃহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.