গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

বর্ষা এবার লেট রান করে ঢুকে পড়ল বঙ্গে। গা ভিজল কলকাতার। বান্ধবীকে গান শোনানোর সময় এল ‘ তুমি বৃষ্টি ভিজোনা ঠাণ্ডা লেগে যাবে’ অথবা এক মনে জয় গোস্বামীর- ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’। আসলে বর্ষা এলেই খিচুড়ি, ইলিশের প্যারালালে, ক্রিয়েটিভ মাইন্ড সটান নেমে পড়ে নেশাতুড় রচনা কর্মে। আর ছবি আঁকিয়েদের ভাবনা বর্ষার স্রোতের মতো উপচে পড়ে ক্যানভাসে। বৃষ্টিতে গা ভেজাতে ভেজাতে তারই একটা ছোট্ট খতিয়ানে এক ঝলক জাস্ট চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। সঙ্গে থাকুক গুনগুন কটি কাব্য রবিবাবুর ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা…।’ আসলে যে কথাটা বলতে চাইছি তা হল বর্ষা নিয়ে শিল্পীরা খুব অ্যাকটিভ। বর্ষা এলেই ওঁদের মনটা কেমন আলবোলা চেহারা ধারণ করে। বর্ষার আবেদনটা ওদের কাছে অনেকটা ওই মন বালিকার মতো। কেউ তাকে নিয়ে গম্ভীর গম্ভীর আবার কেউ যেন উদাসী। মোট কথা বর্ষার আবেদন অগ্রাহ্য করা যায় না বলেই তাঁদের তুলিতে যুগে যুগেই মেঘমল্লার। বাদশাহী আমল থেকেই তার রমরমা। কত যে রাজা-বাদশার পৃষ্ঠপোষকতায় ঝড়, মেঘ, বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, রাধার অভিসারের বা যুগলে বসে মেঘের আগমন দেখার ছবি তৈরি হয়েছে তা গুণে শেষ করা যায় না। সে সব শিল্পীরা ছিলেন আইন মানা লোকজন। মল্লারের স্বরের চলন, প্রত্যেকটা স্বরের শাস্ত্রগত রঙ এবং মেঘ মানে কৃষ্ণ আর বক মানে রাধিকা এ সব সাইন, সিম্বল, সেমিয়টিকস-এ তাঁরা ছিলেন দস্তুর মতো ওস্তাদ।

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর

তবে বাংলার ছবিতে আবার বর্ষার মেজাজটা অন্য জাতের। ডুবু ডুবু মাঠ প্রান্তর, ছাতা মাথায় মানুষ অথবা কোন কাল্পনিক মেঘবালিকার হাতে বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল অথবা সরাসরি বন্যা এলো ডুবে গেল শহর। একবার অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুরে জমিদারি সামলাতে গেলেন। শাহজাদপুর তখন বর্ষায় ডুবু-ডুবু। গ্রামগঞ্জ, কাছারি বাড়ি, রেলস্টেশন সবই গিয়েছে ভেসে। জমিদারির হিসেব নিকেশ প্যাটরাতে ভরে রেখে পারিবারিক বোট নিয়ে রঙ তুলি আর কাগজ নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ চললেন বাংলার জল থৈ থৈ অবস্থার ছবি আঁকতে। তিনি শাহজাদপুর ঘোরেন আর ছবি এঁকে রাখেন বর্ষার। এ হল ছবি আঁকিয়ে জমিদারের বর্ষা বিহার। অবনীন্দ্রনাথের মতো তাঁর অগ্রজ গগনেন্দ্রনাথও গ্রাম বাংলার বর্ষার ছবি এঁকেছেন। কিন্তু রবি কাকার সঙ্গে যুগলবন্দিতে যা করেছেন সে কথা না বললেই নয়।

বিকাশ ভট্টাচার্য

বাংলা ১৩১৯। শিলাইদহ’র নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ৫৫ নম্বর আপার চিৎপুর রোডের আদি ব্রাহ্ম সমাজ প্রেস থেকে ছেপে প্রকাশ করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন স্মৃতি’। সেই লেখার জন্য পাতায় পাতায় ছবি আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের লেখা ছবিতে যেন কথা বলে উঠল আলাদা ভাবে প্রাণ পেল। জীবন স্মৃতির সেই পর্বে রবীন্দ্রনাথ বর্ষার বিবরণে জোড়াসাঁকো ভেসে যাওয়ার কথা লিখেছেন, আর বলেছেন মাষ্টার মশাই অঘোর বাবুর আগমনের কথা। সেই ছবিকেই আদর মাখা ওয়াশে মূর্ত করলেন গগনেন্দ্রনাথ। মূর্ত করেছেন কলকাতার আকাশে মেঘ জমার গল্পকেও। তাই বলতেই হয় বর্ষার আবেদন যেন বারে বারেই যথার্থ শিল্পীদের তুলিকে স্পর্শ করেছে আপন বিশিষ্টতায়।

‘মেঘদূতের’ সাহিত্য সৃষ্টিকে নিবিড় অলঙ্করণ করেছিলেন রাম গোপাল বিজয় বর্গীয়। কী অসাধারণ সেই রেখার চলন। মেঘের চলনের রেখা থেকে চয়ন করে তুলে আনা সেই রেখা আমাদের আশ্চর্য করে। বর্ষা আঁকার কাহিনি অনেক। একবার রামকিঙ্কর বেইজ শান্তিনিকেতনের ক্যানেল পাড়ের সেতুর ওপর নেমে আসা প্রবল বর্ষার ছবি ফুটিয়ে তুলেছিলেন ‘লিনো কাটে’। ছাতা মাথায় ছোট্ট মানুষটির তাল বেতল অবস্থা এক লহমায় বর্ষার তাণ্ডবের চেহারাকে স্পষ্ট করে তোলে। এভাবেই বাংলার শিল্পীদের হাতে বর্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছে। সমকালের বিকাশ ভট্টাচার্য্য আরও অনেকেই এঁকেছেন বর্ষার ছবি। সে সব মন ভেজানো ছবিতেই এবার একটু চোখ বোলানো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.