প্রবন্ধ : এক বিস্মৃত অধ্যায় : শশাঙ্ক ও বঙ্গাব্দ

বাঙ্গালীর ইতিহাস বিমুখতা নিয়ে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের বহুচর্চিত আক্ষেপের এক জ্বলন্ত উদাহরণ বঙ্গাধিপতি মহারাজা শশাঙ্ক । বাঙ্গলার প্রথম সার্বভৌম সম্রাট শশাঙ্কের মূল্যায়ন আজও হয়নি, প্রকারান্তরে প্রতিনিয়ত হয়েছে তাঁকে ভুলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। বাঙ্গলার ইতিহাসে যাঁর স্থান হতে পারত সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ও সম্মানিত, তাঁকে চিনলই না অধিকাংশ বাঙ্গালী। সৌজন্যে বাঙ্গালীর ইতিহাসচর্চার পরনির্ভরশীলতা। আরব সাম্রাজ্যবাদ ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের দুষ্টচক্রে মহারাজা শশাঙ্ক হারিয়ে গেছেন। মহারাজা শশাঙ্ক ছিলেন বাঙ্গালী হিন্দু নৃপতি। বাঙ্গালীকে হিন্দুত্বের থেকে দূরে রাখতে সদাপ্রয়াসী আরবমদতপুষ্ট ও ইংরেজ ঐতিহাসিকরা তাঁকে চরম বৌদ্ধবিদ্বেষী সাজিয়ে চিরকাল তাঁকে হীন ভাবে উপস্থাপিত করে গেছেন


মহারাজা শশাঙ্কের প্রথম জীবন ও বংশ পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। কেউ তাঁকে গুপ্তবংশজাত মনে করেছেন। যদিও স্বপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রোটাসগড়ের পর্বতদূর্গে পাওয়া সীলের ছাঁচে খোদাই করা লিপিতে শ্রী মহাসামন্ত শশাঙ্কের নামের উল্লেখ দেখে অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, শশাঙ্ক প্রথম জীবনে কোন সার্বভৌম রাজার অধীনস্থ সামন্ত রাজা ছিলেন। কিন্তু কে সেই সার্বভৌম রাজা সেই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতপার্থক্য রয়েছে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, শশাঙ্ক গুপ্তবংশের শাসক মহাসেনগুপ্তের অধীনে সামন্তরাজা ছিলেন। ঐতিহাসিক ডি. সি. গাঙ্গুলী মনে করেন যে শশাঙ্ক মগধে মৌখরীরাজ অবন্তীবর্মনের অধীনে সামন্ত ছিলেন।


উত্তরাপথের পরাক্রান্ত সম্রাট হর্ষবর্দ্ধনের সাথে চিরবৈরীতাকে সম্বল করেই শশাঙ্ককে কলঙ্কিত করা হয়েছে চিরকাল। বস্তুত শশাঙ্ক সম্পর্কে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তার অনেকটাই হর্ষবর্দ্ধনের সভাকবি বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’, হর্ষবর্দ্ধনের কৃপাধন্য চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙের ভারত ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘সি-ইউ-কি’ ও বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ থেকে। স্বভাবতই হর্ষবর্দ্ধনের বিরোধী শশাঙ্ককে যথেচ্ছ কালিমালিপ্ত করা হয়েছে ঐসব গ্রন্থে। বর্তমান যুগের আরবমদতপুষ্ট ও কমিউনিস্ট ঐতিহাসিকরাও ঐ সকল গ্রন্থকে তুলে ধরে তাদের বাঙ্গালী বিদ্বেষকে আরো প্রকাশিত করে।

কর্ণসুবর্ণের অতীত:
অনুমান করা যায় যে ৫৯৪ খৃস্টাব্দে শশাঙ্ক গৌড়ের সিংহাসনে আরোহন করেন। তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণে, যা বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের ছয় মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। চৈনিক পর্যটক বর্ণিত রক্তমৃত্তিকা বিহার ‘লো-তো-মি-ছি’ এখানেই ছিল বলে অনুমান করে ১৯৬০-এর দশকে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান শুরু হয়। রাজবাড়িডাঙ্গা নামক স্থানে মাটির ঢিবি খনন করে রাজা কর্ণের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। রাক্ষসীডাঙ্গার ধ্বংসস্তূপ খননে পাওয়া যায় আনুমানিক সপ্তম শতকের বৌদ্ধ বিহারের চিহ্ন। উৎকীর্ণ লিপিসহ পোড়ামাটির ফলকের (ধর্মচক্র-প্রতীক) আবিষ্কার ও এতে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহার নামের উল্লেখ এর শনাক্তকরণকে নিশ্চিত করেছে।


হিউয়েন-সাং কর্ণসুবর্ণের যে বর্ণনা দিয়েছেন তার সাহায্যে এর অবস্থান ও অধিবাসী সম্পর্কে জানা যায়। তাঁর মতে, দেশটি ছিল বেশ জনবহুল ও এখানকার মানুষ ছিল বেশ স্বচ্ছল। এলাকাটি ছিল নিচু ও স্যাঁতসেতে। নিয়মিত চাষাবাস হতো, ফুল ও ফলের প্রাচুর্য ছিল। এখানকার আবহাওয়া ছিল নাতিশীতোষ্ণ। জনগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁরা ছিলেন শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক। তাঁর বর্ণনায় দেশটির সমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।
কর্ণসুবর্ণের লিপিতাত্ত্বিক প্রমাণ মেলে কামরূপের শাসক ভাস্করবর্মণের নিধনপুর দানপত্র থেকে। এ দানপত্রটি কর্ণসুবর্ণের বিজয় ছাউনি (জয়-সরদ-অনবর্থ-স্কন্ধবারাত কর্ণসুবর্ণ-বাসকাত) থেকে প্রদান করা হয়েছিল। এতে বোঝা যায় যে, স্বল্প সময়ের জন্য শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ কামরূপের শাসক ভাস্করবমর্ণের হাতে চলে গিয়েছিল। সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে কর্ণসুবর্ণ আবার কিছু সময়ের জন্য জয়নাগের প্রশাসনিক কেন্দ্রও ছিল। জয়নাগের বপ্য ঘোষবৎ দানপত্র থেকে এই তথ্য পাওয়া যায় [স্বস্তি কর্ণ(স)উবর্ণকাস্থিতস্য মহারাজাধিরাজহ (জ) পরম ভগবত শ্রী-জয়নাগ(দে)বশ্য]।


হিউয়েন সাং -এর লেখা থেকে আমরা কর্ণসুবর্ণের জনগণের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে ধারণা পাই। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ এখানে বসবাস করত। এখানে বৌদ্ধ ধর্ম যে সমৃদ্ধ অবস্থায় ছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ হলো যে, কর্ণসুবর্ণের নিকটই অবস্থিত ছিল বিশাল ও বিখ্যাত মহাবিহারটি। হিউয়েন সাং-এর বিবরণ থেকেই জানা যায় যে, সম্মতীয় স্কুলের বৌদ্ধগণ প্রধানত কর্ণসুবর্ণের দশটি মঠেই বাস করত। বৌদ্ধ মঠ ছাড়াও এখানে পঞ্চাশটি দেব মন্দিরও ছিল।


খননকৃত রাজবাড়িডাঙ্গার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কর্ণসুবর্ণকে একটি নগর কেন্দ্র হিসেবে ইঙ্গিত করে। তবে বেশ কিছু গ্রামীণ বসতি যেমন পাঁচথুপি, গোকর্ণ, মহলন্দি, শক্তিপুর প্রভৃতির অস্তিত্ব রাজধানী শহরের চারপাশে ছিল। এরা সম্ভবত নগরবাসীর প্রয়োজনীয় বস্তুর চাহিদা পূরণ করত। সম্ভবত এ অঞ্চলের সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। মালয় উপদ্বীপের ওয়েলেসলী অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত পঞ্চম শতাব্দীর একটি উৎকীর্ণ লিপিতে রক্তমৃত্তিকা থেকে আগত জনৈক মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্য আর একটি তথ্য অনুযায়ী রক্তমৃত্তিকা থেকে মালয় উপদ্বীপে আগত একটি বড় জাহাজের ক্যাপ্টেনের উপস্থিতি বাঙ্গলার সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সামুদ্রিক বাণিজ্যের ইঙ্গিত দেয়।


বর্তমান :
বর্তমানে কর্ণসুবর্ণ কাটোয়া-আজিমগঞ্জ শাখার একটি রেলস্টেশনহাওড়া থেকে দূরত্ব ১৯২ কিলোমিটার। স্টেশন থেকে ২/৩ কিলোমিটারের মধ্যেই রাজবাড়ীডাঙ্গা ও রাক্ষসীডাঙ্গা। রাজবাড়ীডাঙ্গা প্রত্নস্থলটি সুবিশাল ও ভারতীয় পুরাতত্ববিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত। লোহার প্রাকারে ঘেরা। তবে সে সবই আলংকারিক। বাস্তবে স্থানীয় মানুষের যথেচ্ছ আসাযাওয়া ভিতরে। এলাকাটি গরু ছাগল চরানো ও অবসর বিনোদনের কাজে ব্যবহৃত হয়। সন্ধ্যা নামলেই বসে মদ্যপানের আসর। সে সবের চিহ্ন তার সর্বত্র। প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন বাঙ্গালীর গর্বের প্রাসাদের ইট লুন্ঠিত হয়ে কত যে ইমারত তৈরী হয়েছে আশেপাশে তার হিসাব নেই। ঐতিহ্য সচেতন সমাজের কাছে এ বড় লজ্জার কথা।
খননকার্য যেটুকু হয়েছে তা খুবই সামান্য। বিশেষজ্ঞের চোখ লাগে না, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়ালেই দেখা যায়- উঁচু নিচু মাটি, কোথাও কিছুটা মাটি সরানো হয়েছে, বেরিয়ে এসেছে প্রাসাদের অংশ। অনেক স্তুপ ঘাসে ঢাকা, সেখানে কোনো প্রকার খননকার্য হয়নি। অনাঘ্রাত ইতিহাস দিন গুনছে প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায়।


প্রত্নস্থলটি অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকলেও তার ঠিক পাশেই মাথা তুলেছে সুবিশাল মসজিদ। স্থানীয় মানুষের যাবতীয় আগ্রহ সেই নবনির্মিত ধর্মস্থলের প্রতিই।
রাজবাড়ীডাঙ্গার কিছুটা দূরে রাক্ষসীডাঙ্গা। এটির অবস্থা আরো শোচনীয়। একটি মাটির ঢিবির পাশে ভারতীয় পুরাতত্ববিভাগ তাদের নির্দেশক লিপিটি লিখেই দায়িত্ব শেষ করেছে। কোনোরূপ খননকার্য সেখানে হয়নি। তবে স্থানীয় মানুষ এখানেও তাদের নিজেদের ইতিহাসকে ভুলতে সচেষ্ট। ‘রাক্ষসীডাঙ্গা’ নামটিই এর প্রমাণ। স্থানীয় লোককথা অনুসারে ওখানে নাকি এক রাক্ষসীর উৎপাত হয়েছিল কোনো কালে। তারপর এক মুসলমান ফকির এসে তাকে মেরে ফেলে। সবাই ধন্যধন্য করে সেই ফকিরের নামে এক মাজার বানায়। বর্তমানে সেই মাজারটি ঐ প্রত্নস্থলের ঠিক উপরেই। স্থানীয় মানুষ এতেও সন্তুষ্ট হয়নি। তারা মাজারের পাশেই একটি ঈদগাহ তৈরীতে হাত দিয়েছে। যদিও আইন অনুসারে প্রত্নস্থলের কয়েকশত মিটারের মধ্যে কোনো স্থায়ী কাঠামো করা যায় না। কিন্তু প্রবল প্রতাপশালী আরব সাম্রাজ্যবাদের প্রতিরোধ করতে বাঙ্গালী এখনো শেখেনি। তাই বাঙ্গালীর গর্বের ইতিহাস হয়ত চিরকালের জন্য চাপা পড়ে যাচ্ছে আরবসাম্রাজ্যের ইমারতের নীচে, যেমন গেছে উত্তর ২৪ পরগণার বেড়াচাঁপার চন্দ্রকেতুগড়।
শশাঙ্কবঙ্গাব্দ:
মহারাজা শশাঙ্কের (Shashanka) শ্রেষ্ঠ অবদান যদি হয় তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য, তবে দীর্ঘস্থায়ী গুরুত্বের দিক দিয়ে হয়ত তারও আগে থাকবে বঙ্গাব্দের প্রচলন। বঙ্গাব্দ, বাঙ্গালীর নিজস্ব কালগণনা পদ্ধতি। মহারাজা শশাঙ্ক তাঁর সিংহাসনে আরোহণকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে যে বর্ষপঞ্জি প্রচলন করেন সেটিই বঙ্গাব্দ। মহারাজ শশাঙ্কের (Shashanka) রাজ্য আরোহনের বর্ষ ৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে বঙ্গাব্দ শুরু হয়। ৫৯৪ খৃষ্টাব্দ ১ বঙ্গাব্দ
বঙ্গাব্দ দখলের চক্রান্ত:
বাঙ্গালীর নিজস্ব সম্পদ বঙ্গাব্দকে দখল করার এক দুষ্টচক্র বেশ কিছু দশক ধরে সক্রিয় আছে। এরা মোগল সম্রাট আকবরকে বঙ্গাব্দের জনক বলে প্রচার করে থাকে। যদিও তা ভিত্তিহীন।
বাংলাদেশে মৌলবাদী ইসলামিক শাসক এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর বাঙ্গলার সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কহীন ইসলামী সংস্কৃতিকে পুষ্ট করার জন্য ‘আকবর বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন’ – এমন একটি প্রোপাগ্যান্ডা চালু হয়, যার পিছনে কোনো যুক্তিই নেই। যেমন –
আইন-ই-আকবরীতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে আকবর হিজরী সন পছন্দ করতেন না বলে তারিখ-ই-ইলাহীর সূচনা করেন। তিনি যদি সত্যিই বঙ্গাব্দের সূচনা করতেন তার ভিত্তি বর্ষ সদ্য প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহী সাথে সমান না রেখে হিজরীর সনের সাথে মেলাতেন না।
★ বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি আকবরের শাসনে এলাহাবাদ, অযোধ্যা, আগ্রা, পাটনা ইত্যাদির মত বারোটি সুবা অধিনস্ত হলেও শুধু মাত্র বাঙ্গলার জন্য পৃথক ভাবে একটি বর্ষপঞ্জি তৈরি করতে যাওয়ার কোনো কারণ নেই
১৫৮৪ সালে যখন বাঙ্গলা সুবার রাজধানী রাজমহল, যা বাঙ্গলার বাহিরে। বাঙ্গলার অধিকাংশ অংশই তখন মুঘলদের হাতের বাহিরে এবং প্রতাপাদিত্য, কেদার রায় ইত্যাদির বাঙ্গলার শাসকদের সাথে বিরোধ। ঠিক সেই সময় বাঙ্গলার মত প্রান্তিক ও একটি সুবার জন্য কেনই বা নতুন একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করতে যাবেন!
পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার ডিহারগ্রাম ও সনাতপন গ্রামে প্রাচীন টেরাকোটার মন্দিরে ৯৬৩ খৃষ্টাব্দের আগের বঙ্গাব্দের উল্লেখ রয়েছে

সুপ্রিয় ব্যানার্জ্জী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.