যখন সময় থমকে দাঁড়ায় – রাজর্ষি আচার্য্য

অনেকদিন আগে, ১৯২০ সালে, যখন ভারত ব্রিটিশ শাসনের অধীনে, সেই সময়ে এক রাতে… 

ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। দূরের পাহাড়টা বৃষ্টির পর্দার আড়ালে একদম সাদা হয়ে গেছে। লম্বা সাহেব এতক্ষণ জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলেন। এবার সরে এলেন। পকেট থেকে ঘড়ি বার করে দেখলেন, রাত প্রায় এগারটা। বিহারের এই প্রত্যন্ত গ্রামে এখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। দেশে এখন নতুন নাকি এক আন্দোলন শুরু হয়েছে… নন-কোঅপারেশান। শোনা যাচ্ছে গান্ধী নাকি এদের নতুন নেতা। সাহেব ঠিক জানেন না। রাজনীতির ব্যাপার থেকে সাহেব অনেক দূরে। তিনি সামান্য ঘড়ির কারিগর। এই গ্রামে থেকে তিনি ঘড়ি বানান, সেগুলো শোভা পায় সব বড়বাবুদের কটেজে, যেগুলো ছড়িয়ে আছে দেশের নানাপ্রান্তে।    

সাহেব টেবিলে এসে বসলেন। টেবিলে একটা ডায়েরি খোলা অবস্থায় রাখা। ডায়েরিটার পাতায় পাতায় বিভিন্ন রকম ঘড়ির ডিজাইন। দেওয়াল ঘড়ি, ট্যাঁক ঘড়ি, কুকু ক্লক ইত্যাদি প্রায় সবরকম ঘড়িরই কোনও না কোনও নকশা আছে সাহেবের ডায়েরিতে। সবকটা নকশা সাহেবের নিজের হাতে আঁকা। একটা পিলসুজ জ্বলছে টেবিলে। সে আলোতে প্রিয় ডায়েরিটার পাতাগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে সাহেব চেয়ারে বসলেন। টেবিলে একটা ঘড়ি রাখা ডায়েরিটার পাশে। ঘড়িটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ সাহেবের দম আটকে এলো, বুকে ব্যথা করে উঠলো। মুখ দিয়ে কথা বেরোবার আগেই সাহেব চেয়ার থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গেলেন, আর উঠলেন না। জানলা দিয়ে ঘরে হালকা বাতাস ভেসে এলো। সেই বাতাসে ডায়েরির পাতা গুলো উলটে যেতে লাগল একটা একটা করে।           

            (১)

বর্তমান সময়, ভারত সরকার সবেমাত্র ঘোষণা করেছেন যে ভারত আপাতত করোনামুক্ত। স্কুল-কলেজে বিদ্যার্থীদের ভীড় বাড়ছে দিনে দিনে। রাস্তায় দেখা যাচ্ছে পুরনোদিনের মত জটলা… এমন একদিন- 

  সকালে ঘুম থেকে ওঠায় আমার সমস্যা আছে। অনেক রাত অবধি বই পড়ি, ফেসবুক করি, গেম খেলি। এতদিন কলেজ ইউনিভার্সিটি বন্ধ ছিল। এবার সেটা শুরু হয়েছে। রিসার্চের অনেক কাজ বাকি। সেগুলোও শুরু করেছি একটু একটু করে। গাইডের নিত্য তাড়ার ঠ্যালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। এইসব কিছু সামলে রাত ১২টার পর সময়টা আমার। সেটা এনজয় করতে করতে যথারীতি কালও ঘুমোতে দেরী হয়ে গেছিলো। সকালে আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, এমন সময়ে ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। কোনোমতে চোখ খুলে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি পার্থ ফোন করেছে। সেই পার্থ, যার সঙ্গে ব্যারাকপুরে গিয়ে সাক্ষাৎ ইতিহাসে ফিরে যেতে হয়েছিলো। একটু অবাক হলাম… ও তো জানে যে এত সকালে আমাকে ঘুম থেকে তুললে গালাগাল খেতে হবে। ফোনটা ধরলাম–

বল।-

শুনেছিস?

মনে মনে বললাম না। শুনিনি। কি করে শুনবো? কোনোমতে বিরক্তি চেপে বললাম,”কি শুনবো?”

”- প্রফেসর উদ্দালোক চন্দ্র মারা গেছেন কাল রাতে।”

শুনে আমার ঘুম ছুটে গেলো। উদ্দালোক চন্দ্র তো আমাদের ডিপার্টমেন্ট, মানে ইতিহাস ডিপার্টমেন্টের ফ্যাকাল্টি! দিব্যি সুস্থ সবল লোক! মারা গেছেন মানে?

পার্থ বলে চলল, “স্যার কাল রাত্তির অবধি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। রাতে ভালো খাওয়া দাওয়াও করেছেন। উনি আলাদা ঘরে ঘুমোতেন। সকালে স্যারের ওয়াইফ ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে প্রতিবেশীদের ডাকেন। তারা এসে ঘরের দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে দেখে যে স্যার মাটিতে পড়ে আছেন। পুলিশ এসেছিলো। স্যারের সোনা দিয়ে বাঁধানো চশমা, মানিব্যাগ আর ঘরের দুটো ব্রোঞ্জের মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে না। বডি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানো হয়েছে। এটুকুই জানতে পেরেছি।”

আমি শুনে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। পার্থ জিজ্ঞেস করল আমি আজ ইউনিভার্সিটি যাবো কিনা। ওকে হ্যাঁ বলে উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। এই খবর শুনে ঘুম আর হয় না। আজ অবশ্য কোনও কাজ করতে পারব কিনা কে জানে। মনটা কেমন একটা হয়ে গেছে।       

        (২)

ইউনিভার্সিটিতে সারাদিন প্রফেসর চন্দ্রের আলোচনাই চলল। স্যার খুবই অমায়িক মানুষ ছিলেন। থাকতেন হরিদেবপুরে। স্যারের দুই মেয়ে। একজন ত্রিবান্দ্রমে থাকে তার স্বামীর সঙ্গে, অন্যজন যাদবপুরে পড়ে, সংস্কৃত নিয়ে। স্যারের স্ত্রী ব্যাঙ্কের কর্মী। হরিদেবপুরে স্যারের বাড়িতে আমরা অনেকবার গিয়েছি। ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্যারের বাড়ির দরজা সবসময়েই খোলা থাকত। কিছু কিছু শিক্ষক থাকেন, যাঁদের সব শ্রেণীর মানুষ সমানভাবে ভালোবাসে। উদ্দালোক স্যার এই ক্যাটেগরিতে পড়েন। স্বভাবতই, এরকম মানুষের আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই বেশ শকড হবে।    

দুপুরে, ক্যান্টিনে আমি আর পার্থ একটু আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ পেলাম। ও আমার টি-শার্টটা টেনে নিয়ে একটা কোণায় গিয়ে চাপা গলায় বলল,

  – শোন সপ্তক, কথা আছে। আমি কাকিমাকে ফোন করেছিলাম। বলেছি পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা এলে যেন আমাকে একটু জানান। উনি রাজি হয়েছেন।আমি বললাম, “কেন? পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কী হবে?” উত্তরে ও বলল, “দেখিই না। এরকম হঠাৎ করে মারা গেলেন স্যার, কারণটা জানতে কৌতুহল হচ্ছে খুব।”আমি আর কথা বাড়ালাম না। সারাদিন নিজের থিসিসের কাজ করে, সন্ধ্যেবেলা বাড়ির দিকে রওনা হলাম। এই সময়ে বাস পাওয়া মুশকিল হয়। 

    দু-তিনদিন পরে, রাত্তিরে খেয়ে দেয়ে সবে একটা বই নিয়ে বসেছি, হোয়াটস্যাপে পার্থর মেসেজ এলো। তাড়াতাড়ি বই রেখে ফোন খুলে দেখি ও লিখেছে, “পোস্টমর্টেমে রিপোর্ট এসেছে। স্যার মারা গিয়েছেন হার্ট অ্যাটাকে। অতিরিক্ত ধূমপান কে কারণ বলছে, শরীরে প্রচুর নিকোটিন পাওয়া গেছে। মৃত্যুর সময় রাত ১০টা থেকে সাড়ে দশটা। কাল ক্যান্টিনে বাকি কথা হবে।”আমার আর ঘুম হয়নি সেই রাতে।                        

(৩) 

  পরদিন ক্যান্টিনে পাঁউরুটি খেতে খেতে পার্থ বলল, “পোস্টমর্টেমে লিখেছে হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু একটা ব্যাপার ধরা পরেছে। স্যারের বাঁ চোখের ওপরে নাকি একটা ছুঁচের দাগ পাওয়া গেছে, আর সেই সঙ্গে আই বলও কিছুটা ড্যামেজড।”

আমি বললাম, “তার মানে?”

পার্থ বলল, “তার মানে, আমার বিশ্বাস এটা স্বাভাবিক মৃত্যু না। হতেও পারে, এটা একটা খুন। পুলিশ তদন্ত করবে নিশ্চয়।”

শুনে আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। কী বলছে ছেলেটা! খুন! আমি ঢোক গিলে বললাম, “ভাই! এসব কী বলছিস! স্যারকে কে খুন করবে? কেনই বা করবে? খুন করে লাভটাই বা কি?

পার্থ বলল, “সেটাই তো প্রশ্ন। ভাবছি একবার স্যারের বাড়ি যাই। যাবি?” 

  এবার আমি দোটানায় পড়ে গেলাম। যেতে তো ইচ্ছা করছে খুবই। কিন্তু এই খুন ফুন শুনলে আমার ভয় লাগে। আমি ভীতু মানুষ। যদি কোনও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি? আমার দোনোমোনো দেখে শেষে পার্থ বলল, “তুই সারাজীবন ভয়ই পেয়ে যা। তোর এই ভয়ের জন্য তোর কিছু হয় না। এই ভয়ের জন্য তুই ইকনমিক্সের তানিয়াকে আজ অবধি বলে উঠতে পারলি না। যা পারিস কর। আমি যাব কাল। এলে আসবি, নয়তো না।”

    আঁতে লাগল। তানিয়ার ব্যাপারটা সত্যি। অনেকবার ভেবেও মেয়েটাকে বলে উঠতে পারিনি। ভয় করে। কিন্তু আর না! পার্থকে বললাম যে যাবো ওর সঙ্গে। 

  পরদিন দুপুরে আমরা গাইডকে বলে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় একটা ধাবাতে চাউমিন খেয়ে নিলাম, কারণ কখন ফেরা হবে ঠিক নেই। বাসে এখনও ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’ মেনে চলা হচ্ছে। তাই মাঝ রাস্তা থেকে বাস পাওয়া একটু ঝামেলা। স্যারের বাড়িতে আমরা পৌঁছলাম দুপুর দুটো নাগাদ। একতলা বাড়ি, সামনে একফালি বাগান, দরজায় নেমপ্লেটে বাড়ির নাম- ‘ঝিনুক’। সবই পরিচিত। কিন্তু আজ যেন বাড়িটা থমথমে। পার্থ এগিয়ে গিয়ে বেল বাজাতেই দরজা খুলে গেলো। কাকিমা দাঁড়িয়ে।

সদ্য যে ঝড় থেকে উঠেছেন বোঝা গেলো। তবে এটা ভালো লাগল দেখে যে কাকিমা বৈধব্যবেশ নেননি। কালারফুল শাড়িই পড়ে আছেন। আমাদের দেখে ভেতরে অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা ঘরে গিয়ে বসলাম। সদ্য স্বামীহারাদের এমনিই মনের অবস্থা কাহিল থাকে। তাদের বেশি সান্ত্বনা দিতে নেই। একা ছেড়ে দিতে হয়। পার্থ দেখলাম ওই সহানুভূতি জানাবার রাস্তাতে হাঁটলই না। আর সান্ত্বনা জানাবার ভাষাও নেই। ও সোজাসুজি বলল, “কাকিমা, পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা খুবই শকিং। আমরা ঠিক বুঝেই উঠতে পারছি না এরকম কী করে হল। এমন কাউকে চেনেন যে এরকম কাজ করতে পারে?”

কাকিমা বললেন , “আমি সেরকম কাউকে জানি না যার সঙ্গে তোমাদের স্যারের কখনও কোনও মনোমালিন্য হয়েছে। সকলের সঙ্গেই তো সুসম্পর্ক রেখে চলতেন উনি। কী করে যে কী হয়ে গেলো…” কাকিমার গলা ধরে এলো।

পার্থ চট করে বলল, “স্যারের ঘরটা একবার দেখা যায়?” কাকিমা বললেন, “হ্যাঁ কেন নয়। রিয়া দেখিয়ে দেবে। পুলিশের লোক এসেছিলো। কিছু ধরতে বারণ করে গেছে, তাই একটু সাবধানে দেখো সব। আমি তোমাদের জন্য চা করি একটু।”

স্যারের ছোটমেয়ে রিয়া আমাদের স্যারের ঘরে নিয়ে গেলো। দেখলাম সব যেমন ছিলো তেমনই আছে। স্যারের টেবিল, বই-খাতা, বিছানা সব নিজের জায়গায়। স্যারের নানারকম শৌখিন জিনিসের শখ ছিলো। সেগুলোতে ঘর ভর্তি হয়ে আছে। আমি একটু সাহস করে রিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম যে স্যারের বডিটা কোথায় পড়েছিল। পার্থ দেখলাম বেশ প্রশংসার দৃষ্টিতে আমার দিকে দেখল।

রিয়া ঘরে ঢোকার দরজার সামনেটা দেখিয়ে বলল, “ওইখানে।” – ঠিক কি হয়েছিলো? যদি অসুবিধা না থাকে, তাহলে বলতে পারো। আমরা স্যারের ছাত্র।- বাবা তাড়াতাড়ি ঘুমোতেন রাতে। রাত ৯টার মধ্যে ওঁর খাওয়া হয়ে যেত। তারপর উনি নিজের ঘরে চলে যেতেন, পড়াশোনা করতেন। ১১টা নাগাদ শুয়ে পড়তেন। সেদিনও এই নিয়মেই চলেছিলেন। ঘর থেকে একটা কথা বলার শব্দ পেয়েছিলাম, কিন্তু সেরকম গা করিনি, কারণ বাবা ওই সময় পড়াশোনা করতেন আর পেপার লেখার সময় মাঝে মাঝে নিজের মনে কথাও বলতেন, তাই মনে হয়েছিলো সেরকমই কিছু হচ্ছে হয়ত। আমি আর মা-ও ওই এগারোটা নাগাদ শুয়ে পড়ি রোজই, সেদিনও তাই করেছিলাম। সকালে উঠে দেখি এই ব্যাপার।- স্যারের বডির আশেপাশে ছুঁচ জাতীয় কিছু পেয়েছিলে?- না, পাইনি।এরপর আমরা দুজনে একটু ঘুরে টুরে দেখলাম। পার্থ বেশ খুঁটিয়ে দেখল ঘরের সবকিছু। বুঝলাম স্যারের এরকম করে চলে যাওয়াটা, তার ওপর আবার চোখের মণিতে আঘাত– এটা ওর মধ্যে দারুণ একটা খটকা তৈরি করেছে।    ফেরার পথে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু বুঝলি?” ও অন্যদিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল, “নাহ।”     

      (৪) 

  “আই-বল ড্যামেজ……ওটাই তো বুঝতে পারছি না”, লাইব্রেরিতে বসে বলল পার্থ। পাঁচদিন হয়ে গেছে স্যার মারা যাওয়ার পর। পুলিশ এসেছিলো আবার। ওরাও সন্দেহ করছে যে মৃত্যুটা স্বাভাবিক না। তবে পুলিশ বিশেষ এগোতে পারেনি এখনও। সারা বাড়ি ওলট পালট করে খুঁজেও এমন কিছু তারা খুঁজে পায়নি, যেটা থেকে খুনের পদ্ধতি আর মোটিভ সম্বন্ধে কোনও ধারণা করা যেতে পারে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট খুঁজে লাভ হয়নি, কারণ ওইদিন সকালে অন্তত পঁচিশ জন ওই ঘরে যাতায়াত করেছে পুলিশ আসার আগে। পার্থ এর মধ্যে আরেকবার স্যারের বাড়িতে গিয়েছিলো এটা জানতে যে স্যার মারা যাওয়ার দিন সন্ধ্যায় কেউ এসেছিলো কিনা অচেনা। জানতে পেরেছে যে এসেছিলো কয়েকজন, কিন্তু অচেনা কেউ আসেনি।

প্রতিবেশীদের মধ্যে তিনজন এসেছিলো- পার্থ তাদের নাম ধাম জেনে নিয়েছে। আর দুজন ছাত্রী এসেছিলো, তাদের নাম আর বাড়ির ঠিকানাও পেয়ে গেছে। পিএইচডি ছাত্র হওয়ার জন্য গ্র্যাজুয়েট বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পরিচয়ই হয়ে যায় একরকম। ছাত্রী দুজনের নাম দেখে পার্থ বলল ওদের চেনে।

 আমি পার্থকে বললাম, “দেখ ভাই, এত খোঁচাস না। পুলিশকে পুলিশের কাজ করতে দে। কেন এসবে জড়াচ্ছিস নিজেকে। তুই ফেলুদাও নোস, ব্যোমকেশও নোস। এসবে জড়াবি, তারপর কেরিয়ারের বারোটা বাজলে?”- আমি জড়াচ্ছি কোথায়? আমার ভয় হচ্ছে যে পুলিশের গোয়েন্দারা একটা পার্টিকুলার মেথডে কাজ করে। তারা যথেষ্টই এফিসিয়েন্ট, তাতে সন্দেহ নেই। এই কেসটা সল্ভও হয়ত করে ফেলবে। কিন্তু হতেও তো পারে যে কোনও একটা ছোট ডিটেল চোখ এড়িয়ে গেল। তাছাড়া, ছাত্র হিসাবে আমাদের একটা কর্তব্য তো আছে নাকি!   

এরপর আর কিছু বলা চলে না। চুপ মেরে গেলাম। বিকেলে একরকম বগলদাবা করেই পার্থ আমাকে স্যারের পাড়াতে নিয়ে গেলো। দেখলাম ও স্যারের বাড়িতে ঢুকলো না। তার বদলে, যে তিনজন প্রতিবেশী ওইদিন সন্ধ্যায় স্যারের বাড়িতে এসেছিল, তাদের বাড়িগুলো জেনে নিল পাড়ার মোড়ের মুদিখানার দোকান থেকে। নামগুলো এখানে বলে নেওয়া ভালো। একজনের নাম প্রিয়ব্রত দত্ত, দ্বিতীয়জন রাজীব বসু, আর শেষজন একজন মহিলা, নাম- সাবিনা বিবি।  

  আমরা প্রথমে গেলাম রাজীব বসুর বাড়িতে। তিনতলা পেল্লায় বাড়ি। বেল টিপতেই কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম। একটু পরে একজন ভদ্রলোক এসে দরজা খুলে দিলেন।

দুজন অচেনা ছেলেকে দেখতে পেয়ে একটু অবাক হয়ে বললেন,- বলুন।-

আপনি কি রাজীব বসু?

– হ্যাঁ। কিন্তু……

– নমস্কার, আমি পার্থ সেন। ইনি আমার বন্ধু সপ্তক বোস। আমরা প্রফেসর উদ্দালোক চন্দ্রের ছাত্র… এটুকু বলতেই দেখলাম ভদ্রলোকের চোখ কুঁচকে গেলো। উনি বললেন,- এ ব্যাপারে তো পুলিশকে বলেছি যা বলার… আবার আপনারা…

পার্থ কথা বাড়তে না দিয়ে বলল,  – না না, আমি সেজন্য আসিনি। আমি শুধু এটা জানতে এসেছি যে সেদিন সন্ধ্যায় যখন আপনি স্যারের বাড়িতে গেলেন, তখন সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছিল কিনা…

সন্দেহজনক মানে স্যারের কথা-বার্তা, ব্যবহার এসবের মধ্যে অ্যাবনর্মালিটি কিছু দেখেছিলেন কিনা।- না। দেখিনি। সব নর্মাল ছিলো।

– আপনি কতদিন এখানে আছেন?

– বছর কুড়ি।

– আচ্ছা।

আপনি কি চাকরি করেন?

– করতাম। ভি আর এস নিয়েছি। একটা বইয়ের দোকানে পার্টনারশিপ আছে এখন ।

– বাহ ভালো। কোথায় দোকানটা?

– বিদ্যাসাগর মার্কেট, দোতলায়।

– লাস্ট একটা কথা। আপনি পরদিন যখন যান দরজা ভাঙার পর, স্যারের আশেপাশে ছুঁচ জাতীয় কিছু চোখে পড়েছিলো?

– ছুঁচ! নাহ।

– আচ্ছা। ধন্যবাদ। আসি তাহলে।
ভদ্রলোক বিদায় জানিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। পরের গন্তব্য সাবিনা বিবির বাড়ি। ইনি বাড়িতে ছিলেন না। তবে, যিনি ছিলেন, তিনি বললেন যে সাবিনা বিবি মাস দুয়েক আগে প্রফেসর চন্দ্রের কাছে কিছু টাকা ধার করেছিলেন। প্রফেসর মারা যাওয়ার দিন ওই টাকা ফেরত দিতে যেতে পারেন।   

এরপর আমরা গেলাম প্রিয়ব্রত দত্তের বাড়ি। ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ পঁয়ষট্টি। আমাদের দেখে প্রথমে বিরক্ত হলেও, শেষ পর্যন্ত ছাত্র শুনে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। বললেন, “আমার ছেলেও রিসার্চ করছে, নরওয়েতে। বছর তিনেক হল ওখানে আছে।”

পার্থ বলল, “বাহ সে তো ভালো কথা। আমরা শুধু কয়েকটা জিনিস জানতে এসেছি। বলতে পারেন  ব্যক্তিগত কৌতুহল থেকেই প্রশ্ন গুলো করা।”

 – বলুন।

– আমরা স্যারের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি যে সেদিন সন্ধ্যায় আপনি স্যারের বাড়িতে গিয়েছিলেন…… আপনি কি সেদিন কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছিলেন?

– না। উনি একদমই নর্মাল ছিলেন। আমি প্রায়ই যেতাম স্যারের বাড়িতে। তখন যেমন হাসি ঠাট্টা করতেন, তেমনই করলেন। আমি তো ভাবতেই পারছি না যে এরম হয়ে যাবে।

– পরদিন তো আপনারা গিয়ে দরজা ভেঙে ব্যাপারটা দেখেন। তখন স্যারের আশেপাশে কিছু পড়ে থাকতে দেখেছিলেন? ছুঁচ জাতীয় কিছু?

– পরদিন সকালে আমিই দরজাটা ভাঙার ব্যবস্থাটা করি। কিন্তু কিছু তো দেখিনি সেরকম। তবে শুনলাম যে ওনার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এরকম কিছুর একটা উল্লেখ আছে। ওনার মেয়ে বলল।

– আচ্ছা। আপনি কি করেন?

– আমার একটা ঘড়ির দোকান আছে, লেক মলের পাশে। একদিন আসুন না। ব্র্যান্ডের ঘড়িও রাখি।

– বেশ তো, যাবো একদিন। আজ আসি।

– আচ্ছা।   

এরপর আমরা আবার বাড়ি চলে আসি। আমার ঘরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে পার্থ বলল যে একটু চা খাবে। আমি মা-কে চা বানাতে বলে দোকানে গেলাম। মাথা ব্লক হয়ে ছিল। হাওয়া দরকার।           

            (৫)   

দু’দিন পরের কথা,  আমি পাড়ার মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছি, এই সময় ফোনটা বেজে উঠল। দেখি স্ক্রিনে পার্থর নাম। ফোনটা ধরতেই শুনলাম, “তোর বাড়ি এসে বসে আছি। তাড়াতাড়ি আয়।” গেলাম বাড়িতে। গিয়ে দেখলাম আমার আধপাগলা বন্ধু হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে। বুঝলাম খবর আছে কিছু। বললাম, “জানি আজ সারাদিন ঘুরেছিস। কোথায় কোথায় গেলি, আর কী জানতে পারলি বল।”

ব্যাকফুটে চলে গেলে পার্থর ডিফেন্স মেকানিজমটা আমি জানি। চশমা ঠিক করবে, গলা খাঁকড়াবে আর তারপর জ্ঞান দিতে শুরু করবে। এবারও তাই হলো। মিনিট পাঁচেক জ্ঞান দেওয়ার পর আসল কথায় এলো, “রাজীববাবুর বইয়ের দোকানটায় গেছিলাম বুঝলি। ভালো ভালো কালেকশন আছে। প্রফেসর চন্দ্রও মাঝে মাঝে বই নিতেন এই দোকান থেকে। তবে রাজীববাবুর দেখা পাইনি। আসেননি দোকানে। অনেক পুরনো বইও দেখলাম।”

আমি বললাম তা, “তা ভালো। আর?”- আর এটা জানলাম যে স্যারের পাড়ার ঘড়ি মশাইয়েরও বইয়ের শখ আছে। প্রতি মাসেই একটা দুটো করে পুরনো বই কেনেন। পাড়ার খদ্দের বলতে এই দুজনই।

– আর?

– আর…… না বাদ দে। ইম্পর্ট্যান্ট না এটা।

– তাহলে একবার ঘড়ির দোকানে চল নাকি। বাড়িতে একটা ঠাকুর্দার আমলের অ্যালার্ম ঘড়ি আছে, অচল পুরো। দেখি যদি ঠিক করানো যায়।

– চল।

বেরিয়ে পড়লাম আমরা। লেক মলের পাশে ঘড়ির দোকান খুঁজে নিতে অসুবিধা হল না বিশেষ। প্রিয়ব্রতবাবু দোকানেই ছিলেন। আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। – এসো ভাই।আমি এগিয়ে গিয়ে ঘড়িটা হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে ঠিক করা যাবে কিনা। উনি দেখে-টেখে বললেন হয়ে যাবে। তারপর বললেন,

– এসো তোমাদের কিছু কালেকশন দেখাই।আমরা গেলাম ভেতরে। একটা বেশ বড় মতন ঘরে অনেক ঘড়ি রাখা। নতুন ডিজিটালের পাশাপাশি সেই পুরনো আমলের গ্র্যান্ডফাদার ক্লক—সবই আছে।

একদিকের দেওয়ালে একটা অন্যরকম দেখতে ঘড়ি ছিলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ওটা কি ঘড়ি?”- ওটকে বলে কুকু ক্লক। এক ঘন্টা পরপর একটা পাখি বেরিয়ে এসে কু-কু করে। দাঁড়াও দেখাই।বলে কাঁটা ঘুরিয়ে ১২টার কাছাকাছি নিয়ে এলেন। সময় হতেই ডায়ালের ওপর একটা ছোট দরজা খুলে গিয়ে একটা কাঠের পাখি বেরিয়ে এসে তিনবার ‘কু-কু’ করে আওয়াজ করে আবার ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর উনি বললেন,- প্রফেসর মারা যাওয়াতে আমার খুব ক্ষতি হল। উনি হাতে এখনও সেই দম দেওয়া ঘড়ি পড়তেন। আমিই সারিয়ে দিতাম মাঝে মাঝে।

– শুনলাম আপনি নাকি অনেক বই পড়েন?

– ওটা একটা শখ।

রাজীবকে বলা থাকে…আমাদের পাড়াতেই বাড়ি। ইন্টারেস্টিং কিছু পেলে দিয়ে যায়।যাক। বইয়ের দোকান তাহলে মিথ্যে বলেনি। আমরা বেরিয়ে পড়লাম দোকান থেকে। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। খিদেও পেয়েছে। দুজনে দুটো এগরোল খেতে খেতে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে থাকলাম। পার্থ বলল আজ ও আমাদের বাড়িতে খাবে। আমার ভালোই লাগে কেউ থাকলে। ভাইবোন নেই, তাই কেউ এলে রাত্তিরে সিনেমা দেখে কাটিয়ে দিই। আজও তাই হবে।          

              (৬)

সকালে আমার যথারীতি উঠতে উঠতে দেরী। ঘুম থেকে উঠে দেখি যে পার্থ আগেই উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। আমার ইংরাজী কাগজ পড়া অভ্যেস। নীচের ঘর থেকে কাগজটা এনে টেবিলের ওপর রেখে মায়ের দেওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে বসলাম। আমার পড়া হয়ে গেলে পার্থ কাগজটা নিল। উলটে পালটে দেখে আবার রেখে দিলো। বলল, “আমি বেরিয়ে গেলাম। ইউনিভার্সিটিতে দেখা হচ্ছে।” 

  ও যাওয়ার পর আধঘন্টাও হয়নি, হঠাৎ দেখি পার্থর ফোন। ফোন ধরতেই খুব উত্তেজিত গলায় বলল, “আজকের কাগজটা অবশ্যই আনবি যখন আসবি, খুব দরকার।”

আমি বললাম, “কেন রে? কী হলো?”

উত্তরে শুধু শুনলাম, “মনে হয় বুঝতে পেরেছি।”এটুকুই যথেষ্ট ছিলো।

আমি বুঝেছি যে ও একটা আশার আলো দেখতে পেয়েছে। ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে নিয়ে নিলাম কাগজটা। পৌঁছে দেখি ও গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। হাত থেকে কাগজটা নিয়ে একটা পাতা খুলে হনহন করে হাঁটা লাগালো ওপর দিকে। আমি পেছন পেছন গেলাম। দেখি ও ঢুকছে বিনতা ম্যাডামের ঘরে। বিনতা ম্যাডাম ইউরোপ থেকে পিএইচডি করে এসেছেন। ম্যাডামের রিসার্চের বিষয় যতদূর জানি গান্ধীযুগের ইতিহাস। তার কাছে আমাদের কী কাজ?

ঘরে ঢুকে পার্থ বলল– গুড মর্নিং ম্যাম। একটা তথ্য একটু জানার ছিলো।

– বলো, কি ব্যাপার।

– স্টিফেন্স অ্যান্ড সন্স…… ঘড়ি কোম্পানি একটা। এর ব্যাপারে কিছু জানেন? ইন্ডিয়াতে অফিস ছিলো বোধহয়।

ম্যাডাম উঠে একটা বই থেকে একটা পাতা বের করে একটু দেখে বললেন, “হ্যাঁ জানি তো। ব্রিটিশ কোম্পানি। অনেক পুরনো। এদের তো অফিস ছিলো কলকাতায়। কিন্তু কারখানাটা বোধহয় এখানে ছিলো না।”

– বিহারের ওদিকে ছিলো কি?

– হ্যাঁ হ্যাঁ। কারেক্ট। কিন্তু কেন?

– আজ যদি এদের একটা ঘড়ি পাওয়া যায়, কীরকম দাম হবে?

– অনেক, অ্যান্টিক পিস হবে সেটা। নিলামে ওঠার মত দাম হবে। কিন্তু কেন?

– পরে বলব আপনাকে ম্যাডাম। সপ্তক, চলে আয়।আমি কিছুই বুঝছিলাম না। তবু ওর পেছন পেছন দৌড়লাম।

সোজা বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পার্থ বলল, “কিছু বুঝছিস না তো? তোর কাগজের এডিটোরিয়াল পেজটা খোল। খুললাম। এবার পার্থ একটা বিশেষ জায়গা দেখিয়ে দিলো। দেখি একপাশে ছোট্ট করে লেখা আছে – ‘A Hundred Years Ago Today…’. অর্থাৎ, আজ থেকে একশ বছর আগে এইদিনে কী হয়েছিল, তার খবর। এগুলো বেশিরভাগই পড়া হয়ে ওঠে না। যাই হোক, খবরটা পড়ে দেখলাম এইদিন বিহারের এক গ্রামে এক সাহেবের মৃত্যুর খবর। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন, রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে হঠাৎ করে সাহেবের মৃত্যুর খবর তার মানে বেশ আলোড়ন ফেলেছিলো ওপর মহলে। সাহেবের নাম- জোনাথন ফিলিপ। ইনি এক ঘড়ি কোম্পানির প্রতিনিধি ছিলেন। সেই সঙ্গে দক্ষ কারিগরও নাকি ছিলেন। শহর থেকে দূরে, বিহারের শান্ত গ্রামে ইনি নানারকম মডেলের ঘড়ি বানাতেন। কোম্পানির নাম- ‘স্টিফেন্স অ্যান্ড সন্স’।

আমি দারুণ চমকে গেলাম। তার মানে! এই জন্যই পার্থ বিনতা ম্যাডামকে এই নামটা জিজ্ঞেস করল! কিন্তু তারপর ও এত উত্তেজিত হয়ে গেল কেন? জিজ্ঞেস করলাম। শুধু বলল, “ইনটিউশন”। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তা এখন কোথায় যাচ্ছি?”

উত্তর এলো, “লেক মলের ঘড়ির দোকান। তার আগে প্রফেসর চন্দ্রের বাড়িতে ফোন করতে হবে। মনে হয় পুলিশ সত্যিই একটা ডিটেল মিস করে গেছে। সেটা ঘড়িবাবু দিতে পারবেন মনে হয়।” আমি জিজ্ঞেস করলাম যে “কী ডিটেল?” ও শুধু বলল, “স্যারের ঘরের ঘড়িটা স্টিফেন্স অ্যান্ড সন্স কোম্পানির।”    

লেক মল অবধি ট্যাক্সিটা গেল না। রাসবিহারীর মোড় আসতেই পার্থ ট্যাক্সিটা থামিয়ে নেমে পড়ল। আমাকে এগিয়ে যেতে বলে নিজে চলে গেল একটু দূরে। আমি আর কী করব হাঁটতে হাঁটতে এসে গেলাম দোকানটার সামনে। একটু পরে দেখি পার্থ আসছে। দেখি ওর চোখমুখ পালটে গেছে একদম। খালি খালি রাসবিহারীর মোড়টার দিকে দেখছে।

একটু পরে দেখি চারটে বাইক আসছে ওইদিক থেকে, প্রত্যেকটায় দুজন করে আরোহী। তাদের দেখে পার্থ বলল, “ওরা গেলে আমি ঢুকবো।” ওরা দোকানের সামনে এসে বাইকগুলো দাঁড় করালো। সবাই ঢুকে গেল দোকানে। এবার দেখি একটা গাড়ি করে তিনজন আসছে। কাছে আসার পর বুঝতে পারলাম ওরা কারা- প্রফেসর চন্দ্রের স্ত্রী, মেয়ে রিয়া আর আরেকটা লোক, চিনি না। ওঁরা গাড়ি থেকে নামতেই পার্থ এগিয়ে গেল। বলল, “আসুন কাকিমা”। আমরা সবাই ভেতরে ঢুকলাম। আর ঢুকেই কেমন সব গোলমাল হয়ে গেল।         

              (৭) 

  ঘড়ির দোকানের ভেতরে তখন হাওয়া গরম। দোকানের মালিক প্রিয়ব্রত বাবু রীতিমত রাগারাগি করছেন। তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে বাইকের আরোহীদের তিনজন। বাকিরা দোকানের মধ্যেই এদিক সেদিকে আছে। পার্থ সোজা গিয়ে প্রিয়ব্রতবাবুর সামনে দাঁড়ালো। তাকে দেখতে পেয়েই উনি একটু সামলে নিয়ে বললেন, “এসব কী বলতো ভাই? অ্যাঁ? দিনে দুপুরে জোর করে দোকানে ঢুকে পড়ছে, দোকানে যেখানে সেখানে উঁকি দিচ্ছে… মানে ব্যাপারখানা কী?”   

পার্থ খুব শান্ত ভাবে বলল, “ব্যাপার এবার বুঝবেন। কী লাভ হল এটা করে আপনার? আপনার লোভ একটা নিরীহ মানুষকে মারল, সেই লোভেই আপনি এবার জেলের ঘানি টানবেন। উত্তেজিত হবেন না বেশি, এই আটজন পুলিশের লোক। কাজেই লাফালাফি করলে ফল হিতে বিপরীত হতে পারে। চুপ করে গোডাউনে নিয়ে চলুন।” প্রিয়ব্রতবাবু চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমাদের গোডাউনে নিয়ে গেলেন।  

  চেনা গোডাউন। পার্থ সোজা চলে গেল দেওয়ালে ঝোলানো কুকু ক্লকটার দিকে। আমরা পেছন পেছন গেলাম। পার্থ  বলল, “এটা আসল, এটা সেদিন দেখেছিলাম। ডামিটা কোথায়?” প্রিয়ব্রতবাবু চুপচাপ একটা আলমারি থেকে একইরকম দেখতে, কিন্তু একটু চকচকে একট ঘড়ি এনে দিলেন। পার্থ সেটাকে পাশের টেবিলটার ওপর রাখল। সবাইকে বলল, “কেউ উঁকি মারবেন না, এটা ডেঞ্জারাস জিনিস।”

নিজে পাশ থেকে কাঁটা ঘুরিয়ে ঘড়ির সময়টা প্রায় বারোটা করে দিলো। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কি হয় দেখার জন্য। বারোটা বাজতেই যথারীতি দরজা খুলে পাখিটা বেরিয়ে এলো। কিন্তু আশ্চর্য! ওটা আবার ভেতরে ঢুকে গেলো না তো! পার্থ এবার খুব সাবধানে পাখিটাকে ধরে হালকা চাপ দিলো। কিছু হলো না। এবার একটু জোরে চাপ দিতেই খট করে একটা শব্দ করে, পাখির ঘর থেকে একটা বেশ বড় মত ছুঁচলো ধাতব কাঠি ছিটকে বেরিয়ে একটু দূর উঠে মাটিতে পড়ে গেলো। আমি সেটা তুলে এনে পার্থর হাতে দিলাম।

কাঠিটা নিয়ে পার্থ বলল, “এটায় বিষ নেই, তবে স্যারের চোখে যেটা লেগেছিলো, সেটায় বোধহয় বিষ ছিলো অনেকটা, তাই না প্রিয়ব্রত বাবু?” প্রিয়ব্রতবাবুর মাথা হেঁট হয়ে গেলো। বললেন “হ্যাঁ।” রিয়া এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। এবার সোজা এগিয়ে গিয়ে ঘড়ির দোকানের মালিকের সামনে দাঁড়ালো। একটুখানি তাকিয়ে থেকে প্রচন্ড জোরে একটা থাপ্পড় মারল প্রিয়ব্রতবাবুকে। উনি গাল চেপে মাটিতে বসে পড়লেন। পুলিশের লোকদের দুজন এগিয়ে গেলেন তাঁর দিকে।

                         (৮)   

ঘড়ির দোকানটার উল্টোদিকে একটা ক্যাফেতে বসে কথা হচ্ছে। আমি, পার্থ, স্যারের স্ত্রী আর মেয়ে রিয়া, তার মাসতুতো দাদা, আর সেই পুলিশদের একজন (ইনি এই আটজনের দলটার লিডার বলা চলে)। কাকিমা প্রথমে বললেন, “এত শোকের মধ্যেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি, নয়ত বিচার পেতে হয়ত একটু দেরীই হত। কিন্তু ভাই, তোমার মাথায় এলো কী করে ব্যাপারটা?”

পার্থ একটু গলা খাঁকড়ে বলা শুরু করল,- দ্বিতীয়দিন যখন আমি স্যারের পাড়ায় আসি, একা ছিলাম। তাই স্যারের বাড়ি আরেকবার আসি। স্যারের মেয়ে ছিলো তখন বাড়িতে…”রিয়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। পার্থ বলে চলল, “সেদিন স্যারের ঘরটা আরেকবার ভালো করে দেখার সুযোগ পাই। অনেক কিছু চোখে পড়ে, তার মধ্যে স্যারের দেওয়ালে কুকু ক্লকটাও ছিলো। ভাগ্যক্রমে, আমি থাকার সময়েই একটা ঘন্টা শেষ হয়, আর পাখি তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জানান দেয়। কিন্তু তারপর, পাখিটা আর ঢোকে না ভেতরে, ঘড়িটাও আটকে যায়। রিয়াকে ডেকে দেখাই। ও জানায় যে এই ব্যাপারটা ও দেখেনি আগে, রিসেন্টলি দেখছে স্যার মারা যাওয়ার পর থেকে।” এই অবধি বলে ও থামল।

আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছি। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে একটুখানি জল খেয়ে আবার শুরু করল, “তারপর আমি যাই বইয়ের দোকানে, মানে রাজীব বাবুর বইয়ের দোকান। ওখানে অনেক কিছু জানতে পারি। বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা বই চোখে পড়ে, ইংরেজ শাসনে ভারতে কারিগরি বিদ্যার বিকাশ সম্পর্কে। সেটা ওলটাতে ওলটাতে একটা চ্যাপ্টারে দেখতে পাই যে সেই সময়ে  কিছু ঘড়ির কোম্পানি ছিলো, যারা এখানে ব্যবসা করত। তাদের মধ্যে একটা কোম্পানি ছিলো স্টিফেন্স অ্যান সন্স।

কিন্তু, তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় তাদের প্রধান কারিগর জোনাথন ফিলিপের হঠাৎ মৃত্যুর পর। কিন্তু তখনও আমার কিছু সন্দেহ হয়নি। এই মৃত্যুর খবর কাগজে বেরিয়েছিলো, যেটা আমার চোখে পড়ে আমার বন্ধু শ্রী সপ্তক বোসের বাড়িতে কাগজের একটা বিশেষ পাতা পড়ার সময়। এটা একটু তলিয়ে ভাবতেই আমার সন্দেহ শুরু হয়। তারপর আমি স্যারের বাড়িতে ফোন করি। জানতে পারি যে, ওইদিন প্রিয়ব্রত বাবু রাত ৯টার একটু পরে এসেছিলেন। এখানে একটা ঝটকা লাগে। রিয়া বলেছিলো ওদের বাড়ির ঘড়ি যে খারাপ, সেটা আগে দেখেনি। এটা হওয়া একটু গন্ডগোলের ছিলো, বিশেষত, ঘড়ি যখন প্রতি ঘন্টায় আওয়াজ করে। তখন মনে হল, যে প্রিয়ব্রতবাবু ঘড়ির মেকানিক, উনি কিছু করেননি তো? ভাবতে ভাবতে মনে হলো, অসম্ভব না!”  

পার্থ আর কিছু বলার আগেই আমি বললাম, “এক মিনিট, প্রিয়ব্রত বাবু জানবেন কী করে এই ঘড়ির যে এত দাম?”

ও একটু হেসে বলল, “ভুলে গেলি? প্রিয়ব্রতবাবুর বই পড়ার শখ? আর রাজীববাবুর বইয়ের দোকান? দুইয়ে দুইয়ে চার কর। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, উনি রাজীববাবুর দোকানে এই বইটা দেখেছিলেন। দেখে ভদ্রলোকের  মাথায় আসে যে এই ঘড়ির তো অনেক দাম হবে আজকের দিনে। অতএব, ঘড়িটা তাঁর চাই। কিন্তু কীভাবে? সরাসরি চাওয়া যায় না, আবার চুরিও করা যায় না। চুরি করলে সেই মাল পাচার করতে সমস্যা, লাভও নেই, কারণ নেটওয়ার্ক অত শক্ত না। তাই উপায়? স্যারকে সরানো।  উনি প্রফেশনাল খুনি নন, কিন্তু হাতে একটা বিরাট অস্ত্র আছে, ঘড়ির মেকানিজম। প্রিয়ব্রত বাবু একটা যন্ত্র বানালেন, এমন একটা যন্ত্র, যাতে স্প্রিং লাগানো থাকবে, আর তাতে চাপ পড়লেই একটা ছুঁচের মত লম্বা জিনিস বেরিয়ে আসবে। তাতে লাগানো থাকবে বিষ!”

পুলিশের ভদ্রলোক বললেন ,”বিষ, কিন্তু পোস্টমর্টেম তো……”

পার্থ বলল, “ইয়েস। বিষ। নিকোটিন। পাওয়াও সহজ, আবার স্যার স্মোক করতেনও, তাই পোস্টমর্টেমে সবাই ধরে নেবে অতিরিক্ত স্মোকিং-এর কারণে ম্যাসিভ অ্যাটাক। তাই এটা যে খুন, কারোর মাথাতেই আসবে না। আশি থেকে নব্বই মিলিগ্রাম নিকোটিন একসঙ্গে শরীরে ঢুকলে ওভারডোজ হয়ে মৃত্যু হতে পারে বৈকি। যাই হোক, যন্ত্র পরীক্ষা করার জন্য উনি বানালেন একটা ডামি ঘড়ি, যেটাকে দেখতে স্যারের বাড়ির মতো। যদিও কোয়ালিটি অনেক বাজে, তবু কাজ চলে যাবে। খুনের জিনিস তৈরী। এবার তাহলে সুযোগের অপেক্ষা। প্রতিবেশী হিসাবে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য উনি গেলেন স্যারের বাড়ি। গেলেন ন’টার পর, যাতে ঘড়িতে কুকু ক্লক জানান দিয়ে দেয়। তারপর সুযোগ বুঝে ঘড়ি ‘চেক’ করে দেওয়ার নাম করে ঘড়ির মধ্যে যন্ত্রটা ফিট করলেন। তারপর দশটা বাজার আগে ফিরে এলেন বাড়িতে। ঘড়িতে দশটা বাজল, পাখিও বেরোলো। কিন্তু ঢুকলো না। স্যার ঠিক করতে উঠলেন, পাখিতে চাপ দিতেই ছুটে এলো ছুঁচ। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু এই বিষে হয় না। কিছুক্ষণ পর নিকোটিন কাজ করা শুরু করল। স্যার হয়ত সিগারেটও খেয়েছিলেন তার আগে… সব মিলিয়ে নিকোটিন ওভারডোজ এবং মৃত্যু। আর ওই অতবড় ছুঁচটা হঠাৎ করে লাগার ফলে স্যার ব্যথায় শকে চলে গেছিলেন, কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। বোধহয় ঘরের মধ্যেই ছোটাছুটি করতে গেছিলেন। আমার ধারণা উনি বাইরে আসার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু দরজা অবধি পৌঁছনোর আগেই অত নিকোটিনের প্রভাবে হার্ট থেমে যায়। উনি মাটিতে পড়ে যান, এবং মারা যান। পোস্টমর্টেমে আসে ম্যাসিভ স্ট্রোক। স্যারের চোখে লাগাটা বোধহয় প্রিয়ব্রতবাবু হিসাব করেননি। উনি ভেবেছিলেন হাতে লাগবে। চোখে লেগেই ব্যাপারটা নজর কাড়ল।”

রিয়া জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু তাহলে অত বড় ছুঁচটা গেল কোথায়?”

পার্থ বলল, “পরদিন সকালে সবার আগে উনি এসেছিলেন তোমাদের বাড়ি, এটা উনি নিজে বলেছেন।  দরজা ভেঙে সবাই ঢোকার পর, সবাই যখন স্যারকে নিয়েই ব্যস্ত, উনি চারপাশ খুঁজে ছুঁচটা তুলে নেন। পাশেই পড়ে থাকবে তাতে আর আশ্চর্যের কি। আর সোনার চশমা, মানিব্যাগ, ব্রোঞ্জের মূর্তি এগুলো নিয়ে নেন, যাতে সন্দেহ অন্যদিকে চলে যায়।”

কাকিমা খুব আস্তে আস্তে বললেন, “আমার শ্বশুরমশাইয়ের ঘড়ি ছিলো ওটা। সেটাই হয়ে দাঁড়ালো মৃত্যুর কারণ।“পার্থ বলল, “প্রিয়ব্রতবাবুর এই কেরামতির জন্যই ঘড়িটা বারবার আটকে যাচ্ছিলো। উনি জানতেন এই ঘড়ি ঠিক করার জন্য তাঁরই ডাক পড়বে। তখন উনি এটাকে মেরামতির অযোগ্য বলে জলের দরে কিনে নিয়ে হীরের দামে বেচে দিতেন। বাড়িতে কারুর মৃত্যু ঘটলে কে আর এসব বিষয় এত খতিয়ে দেখে! বুঝেছো রিয়া?” রিয়া মাথা ওপর নীচ করল।

                         (৯)

পরদিন খবরের কাগজে এই নিয়ে হইচই। যথারীতি পার্থ বলে দিয়েছিল যে আমাদের নাম যেন কোনওভাবেই কাগজে না বেরোয়। এই ব্যাপারটায় আমি খুশি। আমি সাদামাটা থাকতেই ভালোবাসি। তবে পার্থ যে এরকম একটা গোয়েন্দার মতো কাজ করে ফেলবে, এটা ভাবতে পারিনি। কাগজে না বেরোলেও, ডিপার্টমেন্টে জানাজানি হয়ে গেছে ব্যাপারটা। আমাদের ডিপার্টমেন্টে ও এখন হিরো। কিন্ত ওর কোনও হেলদোল নেই। দিব্যি নিজের কাজ করছে। বিকেলে হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট আমাদের ডেকে পাঠালেন। গেলাম আমরা। প্রথমেই অভিনন্দন জানালেন। বললেন, “উদ্দালোকের চলে যাওয়াটা যতবড় ক্ষতি, তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ যে তোমরা আমার ডিপার্টমেন্টের ছাত্র। তোমাদের স্যারকে তোমরা যথাযোগ্য সম্মান দিয়েছ। যদিও ভবিষ্যতে এই ধরণের ঝুঁকির কাজে না যাওয়ারই পরামর্শ দেবো।”

পার্থ বলল, “না স্যার, এটা বলতে পারেন লাক বাই চান্স। আমার এই বন্ধুর বাড়িতে ইংরাজি কাগজটা না পড়লে মাথায় আসত না কিছু।”এইচ ও ডি স্যার বললেন, “যাই হোক। আমাকে কিছুদিন বাইরে যেতে হবে, শুনেছি মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে নাকি হিউয়েন সাঙের কিছু পুঁথি আবিষ্কার হয়েছে, সেই নিয়ে সেমিনার আছে। আমি চাই, তোমরাও আমার সঙ্গে চলো।” এই প্রস্তাবে না বলা যায় না। দুজনে সমস্বরে বললাম, “যাবো স্যার, থ্যাঙ্ক ইয়ু স্যার।” বেরিয়ে এলাম স্যারের ঘর থেকে। 

বিকেলে পার্থ বলল, “স্যারের বাড়ি যেতে হবে, কাকিমা আর রিয়া একটু যেতে বলেছে।” গেলাম স্যারের বাড়ি। কাকিমা আমাদের ঘরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরে ফিরে এলেন, হাতে একটা বড় কাঠের বাক্স। সেটা আমাদের হাতে দিয়ে বললেন, “এটা আমাদের তরফ থেকে তোমাদের জন্য একটা উপহার। খুলে দেখো, চলবে কিনা।”

বাক্সটা টেবিলের ওপর রেখে খুলে দেখি ভেতরে শোভা পাচ্ছে প্রায় একশ বছর আগে, ইংল্যান্ডের এক বিখ্যাত ঘড়ি কোম্পানি, স্টিফেন্স অ্যান্ড সন্সের তৈরি একটা কুকু ক্লক, যা কিছুদিন আগে আলো করে থাকত প্রফেসর চন্দ্রের ঘরের দেওয়াল, এবং, যা ছিল এই ক’দিনে ঘটে যাওয়া নাটকটার মুখ্য চরিত্র। কাকিমা বললেন, “এর দাম এখন সবাই জানে, কিন্তু মূল্যটা বোধহয় তোমরাই বুঝবে।”   

পার্থ কাকিমাকে ভালো করে প্রণাম করে, হেসে বলল, “থ্যাঙ্কস।” 

[সমস্ত ঘটনা এবং চরিত্র কাল্পনিক]
(কবিতাটি পূর্বে তৃতীয়পক্ষ পত্রিকার রথযাত্রা সংখ্যায় প্রকাশিত )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.