Education is the manifestation of perfection already in man” – স্বামীজীর এই অমৃত-সমান বাণী আমরা শুনেছি বহুদিন ধরেই, কিন্তু বাস্তবে তা প্রয়োগ করার সদিচ্ছা বা উদ্যোগ সেভাবে চোখে পড়েনি। সেই চিরাচরিত কেরানি তৈরির মেশিনই চলে আসছে বছরের পর বছর। কিন্তু ৩৪ বছর পরে, এই নয়া শিক্ষানীতির খসড়া মনে একটু আশার আলো জাগালো বৈকি, যদি না এটা শুধুই স্বামীজীর বাণীর মতোন কাগজে কলমেই থেকে যায়। সবকিছু চলছিল একই নিয়মে ৩৪ বছর ধরে। বিশ্বায়নের থাবায় সবকিছু পরিবর্তিত হলেও শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো সেই মান্ধাতা আমলের। ছোটো খাটো দু একটা পরিবর্তন হলেও একটা যে আমূল পরিবর্তন কতটা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল তা বুঝতে আমাদের অনেক দেরী হয়ে গেলো। বলতে পারি, “দের আয়ে, দুরুস্ত আয়ে”। এই যুগে দাঁড়িয়ে এই নয়া শিক্ষানীতি যে কতটা উপযুক্ত পদক্ষেপ তা সময়ই বলবে। স্বভাবতই এক শ্রেণীর বিরোধী চিন্তাভাবনা যুক্ত মানুষ, যারা গরম বেশী লাগলেও একটি বিশেষ দল ও মানুষদের দোষ দেন, এক্ষেত্রেও তারা নিরাশ না করে বিরোধিতা করেছেন, করতেই পারেন। আমাদের দেশে এত বৈচিত্র্য যে, এই ১৩০ কোটির দেশে কোনো নিয়ম চালু হলে বা পরিবর্তিত হলে প্রত্যেকের জন্য তা উপযুক্ত হতে পারে না। তাই পরিবর্তন হলে শুনতে হয়, কেন হলো? আর না হলে, এরা কিস্যুই করেনা

যাইহোক, এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক কি আছে এই নয়া শিক্ষা নীতিতে – কেরানি তৈরি করা নয়, প্রকৃত শিক্ষা ও বিজ্ঞান বোধে গুরুত্ব। জিডিপি এর ৬% শিক্ষাখাতে খরচ (বর্তমানে ৪.৬%), কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রকের নাম বদলে, হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রক। প্রাথমিক শুধু নয়, ১৮ বছর পর্যন্ত শিক্ষার অধিকার। মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব। সেমিস্টার থাকছে ক্লাস ৯-১২ পর্যন্ত প্রায় ৮ টি , কিন্তু পরীক্ষা, রেজাল্টের ধরণ সব পালটে যাবে, ফলে, তারা যা শিখছে তা সেমিস্টার এর মাধ্যমে এসেসমেন্ট করা যাবে, এবং তা নির্ধারণ এর জন্য PARAKH নামে একটি জাতীয়করণ মূল্যায়ন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। মাধ্যমিক পরীক্ষার গুরুত্ব আর থাকছে না। ১০+২ সিস্টেম উঠে যাচ্ছে, স্কুল শিক্ষাটা হবে, ৫ (একদম প্রাথমিক শিক্ষা) + ৩ (গ্রেড ৩-৫)+ ৩ (গ্রেড ৬-৮) + ৪ (গ্রেড ৯-১২) অর্থাৎ ক্লাস সিক্স পর্যন্ত বেসিক এডুকেশন চলতে থাকবে। ক্লাস ৬ থেকে ৮ সাবজেক্টিভ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। আর ক্লাস ৯ থেকে ১২ উচ্চ শিক্ষার বুনিয়াদি শিক্ষা। ক্লাস ১২-এ ,আলাদা কোনও স্ট্রিম থাকছে না। সায়েন্স পড়লেই আর্টসের সাবজেক্ট নিতে পারবেনা, সে ব্যাপারটা পাল্টাচ্ছে। সাইন্স- আর্টসের দূরত্ব কমছে। আলাদা করে সাইন্স, আর্টস, কমার্স থাকছে না। কেউ ফিজিক্স নিয়ে পড়ার সাথে সাথে ফ্যাশন টেকনোলজি নিয়েও পড়তে পারে। ক্লাস ৬ থেকেই ভোকেশনাল ট্রেনিং। এমনকি ১০ দিনের ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থাও থাকবে। ধরা যাক, কেউ ইলেক্ট্রিকের কাজ শিখতে চায়। সে ক্লাস সিক্স থেকেই শিখতে পারে। ই-লার্নিংয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। ৮টি ভাষায় আপাতত অনলাইনে পড়াশোনা চলবে। ক্লাস ৬ থেকেই কম্পিউটার কোডিং শেখা যাবে। বিজ্ঞানবোধকে বাড়ানোর চেষ্টা চলবে। ক্লাস ৫ পর্যন্ত মাতৃভাষা শেখা মাস্ট। এরপর তা ঐচ্ছিক, ৩ ভাষার ফর্মুলা থাকছে। পরীক্ষার রেজাল্ট আগে যেরকম হতো, তাতেও বদল আসছে। মুখস্ত করে উগরিয়ে দিয়ে নম্বর তোলা যাবেনা। ছাত্রের দক্ষতাকেই গুরুত্ব। ৩/৪ বছর পর্যন্ত অনার্স করা যাবে। এরপর ১/২ বছর পোস্ট গ্রাজুয়েশন। বিশ্বের সেরা ১০০টা ইউনিভার্সিটি এদেশে তাদের ক্যাম্পাস খুলতে পারবে। এম ফিল উঠে যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটিগুলোতে ভর্তির কমন এন্ট্রান্স টেস্ট। উচ্চশিক্ষায় এন্ট্রি বা এক্সিটে অনেক সুযোগ থাকছে। যেমন, ৩-৪ বছরের গ্রাজুয়েশন। কেউ মনে করলেন, ১ বছর পর আর পড়বেন না। তাহলে তাঁকে ওই ১ বছরেরই সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। ২ বছর হলে অ্যাডভান্সড ডিপ্লোমা। আগে এক বা দু বছর পর গ্রাজুয়েশন ছেড়ে বেরোলে কিস্যু হতো না। টুয়েলভ পাশ হয়েই থাকতে হতো। এভাবেই কেউ এক বছর কোর্স করার কয়েক বছর পর আবার ওই সাবজেক্টে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে চাইলে, সেকেন্ড ইয়ার থেকেই সে ভর্তি হতে পারবে। এখন এই খসড়া কিভাবে আত্মনির্ভর ভারতের সাথে সম্পর্কিত বিশ্লেষণ করা যাক। আমরা জানি কিছুদিন আগেই গালওয়ান উপত্যকায় চীন সেনার কাপুরুষোচিত হামলা ও ভারতীয় সেনার পাল্টা মার। এই সংঘাতে আমরা হারাই আমাদের 20 জন বীর বাহাদুর সৈনিকদের। তারপর থেকেই জোরদার ভাবে উঠতে থাকে আত্মনির্ভর ভারত গড়ার ডাক। কিন্তু এই প্রচেষ্টা যে একদিনের নয়, এর শুরু অনেক আগেই। স্কিল ইন্ডিয়া এবং মেক ইন ইন্ডিয়া মুভমেন্ট এর সময় থেকেই। কিন্তু বুনিয়াদি শিক্ষাস্তরে তখনও তা রূপায়িত করা যায়নি। তবে এবার তাই হতে চলেছে। অর্থাৎ রেজাল্টের আদিখ্যেতা আর পড়াশুনার একতরফা বোঝা কমিয়ে কারিগরি ও কৌশল-বিদ্যার উপর জোর দেওয়া হলো। ফলে স্কুল থেকে বেরোনো সব যুবকই হাতের কাজ শিখে রাখতে পারবে। এতদিন সবাই হয় কেরানি, না হলে শিক্ষক হবার আশায় দৌড়ে থাকতেন। কিন্তু কৌশল গত বিদ্যার ভাঁড়ার ছিল প্রায় শূণ্য। ফলে ওই শূন্যস্থানগুলি ও ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কারিগরি শিল্পেও হাত বাড়াতো চীন। কিন্তু এবার থেকে যুবকরা তাদের মনের মতন কারিগরি ও কৌশল বিদ্যা শেখার ফলে যেমন বেকারত্ব কমবে, তেমনি আত্মনির্ভরতাও বাড়বে। আরও একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্লাস ৬ থেকে কোডিং শেখানো। যা ভবিষ্যতের ভারত কে কম্পিউটার সায়েন্স, এথিক্যাল হ্যাকিং, ও সাইবার ওয়ারফেয়ার এর জন্য বুনিয়াদি স্তর থেকেই তথ্যপ্রযুক্তি মনস্ক করে তুলবে। তাই এই নয়া শিক্ষানীতিতে যে আত্মনির্ভরতা ও শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার ইচ্ছা ও বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। এছাড়া মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা না হওয়া, সংস্কৃত ভাষা কে সর্বস্তরেই ইচ্ছুক রাখা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবুও কিছু আশঙ্কা থেকে যায়, যেমন খসড়া তৈরি সহজ হলেও বাস্তবায়ন জরুরী। আমাদের সামনে অনেক প্রতিকূলতা আসবেই, নিচুস্তরে দুর্নীতি থেকে শুরু করে কম্পিউটার ও বিদ্যুৎহীন স্কুল। আমাদের নজরে রাখতেই হবে কোনো শিশুই যেন বঞ্চিত না হয় এই বিশাল ব্যবস্থা থেকে। নয়তো এই খসড়া শিক্ষানীতি কাগজ কলমেই থেকে যাবে। তবুও সরকারের সদিচ্ছাকে সাধুবাদ জানাই। মনে হয় আমরা সত্যি ধীরে ধীরে স্বামীজীর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি।

রাজদীপ চ্যাটার্জী (Rajdeep Chatterjee)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.