মজিদ মাস্টার – শাহাজান, সন্দেশখালির ফরমান

কেন সন্দেশখালি আজ উত্তপ্ত? মজিদ মাস্টার বা শাহাজানরা কারা? বিকৃত ইতিহাস কিভাবে আমাদের ভুল পথে চালাচ্ছে? এখানে জমি রাজনীতির ইতিহাসটা জানতে হবে l আমাদের প্রতিদ্বন্দী কতটা ভাল খেলে এবং আমাদের মূর্খতার সীমাবদ্ধতা কতটা সেটাই জানতে হবে l

হিন্দু বাঙালীকে বাঁচতে গেলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ছেড়ে, এই ব্যাপারটা বুঝতে হবে l বাংলার সংস্কৃতির একটা বড় অংশ এই জমির খেলা l কয়েকশ বছরের খেলা l তবে গত ৯০ বছর একটু দেখি l

বহু বাঙালী জানেন না, স্বাধীনতার আগেই ১৯৩৫ এ ভারতে প্রথম গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রদেশে ভোট শুরু হয় l কৃষক প্রজাপার্টি প্রথম নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং তাদের নেতা ফজলুল হক প্রধানমন্ত্রী হন l ফজলুল হক যে অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, এই ইতিহাসটা আমাদের বই থেকে খুব চাতুরীর সঙ্গে চেপে দেয়া হয়েছে, হিন্দু বাঙালীকে ‘সেক্যুলার ও সোশ্যালিস্ট’ বানিয়ে রাখার তাগিদে l ১৯৩৫ এ ফজলুল হক দাবী করেন, হিন্দু জমিদারদের জমি কেড়ে নেবার দাবী করেন, কোন ক্ষতিপূরণ না দিয়ে l স্বাধীনতার আগে তিনবার গনতান্ত্রিকভাবে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং সোরাবর্দি l নেতাজী বা প্রফুল্ল ঘোষ বা সুরেশ ব্যানার্জী বা বিধান রায় নন l এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, নৌ বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতা l দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরে এবং স্বাধীনতার আগে এবং ১৯৪৭ এ ৭৫% বাংলা নিয়ে যাওয়ার পর চোখ পড়ে পশ্চিমবঙ্গের দিকে l

প্রথম দিকে এঁরা বেশ চুপচাপ ছিল এবং খেলা দেখছিলো l ১৯৫৫ তে স্টালিনের মৃত্যুর পর, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করার লক্ষ্য নিয়ে এমন কিছু জায়গা খোঁজে যেখানে প্রবেশ করা সহজ l কলকাতা এবং বোম্বে তাঁদের চোখে পড়ে, যেহেতু ভারতের জিডিপির একটা বড় অংশ এই দুই মহানগরী থেকে আসতো l এঁরা মূলত: শিক্ষাজগৎ, সংস্কৃতিজগৎ, শ্রমিক ও কৃষক ইউনিয়ন এবং সংবাদ মাধ্যমকে টার্গেট করে মানুষের মস্তিস্ক প্রক্ষলনের জন্য l বোম্বেতে এঁরা সফল হয় না l রাজ কাপুর থেকে ঋষিকেশ মুখার্জীরা কিছু চেষ্টা করে l কিন্তু বোম্বে বরাবার ইতিবাচক l বোম্বেতে ‘নমক হারাম’ ছবি কোন দাগ কাটে নি l মৃনাল সেনের নেতিবাচক ‘আকাশ কুসুম’ ছবির হিন্দি রিমেককে ইতিবাচক করে হিন্দিতে ‘মঞ্জিল ‘ করতে হয় l

কিন্তু কলকাতায় সফল হয় বামপন্থীরা l তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর অবর্তমানে হিন্দু মহাসভা পিছিয়ে পড়েছে l এঁরা টার্গেট করে মূলত: বিক্ষুব্ধ ব্রাহ্ম সমাজের একটা অংশ এবং আন্দামান জেলে অনুশীলন ও যুগান্তর থেকে কমিউনিস্ট হয়ে যাওয়া কিছু নেতাকে l ক্রুশচেভ, বুলগানিনরা বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী-বোকা জনগোষ্ঠী খুঁজে পায় l শুরু হয় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন l বিধানচন্দ্র রায় কংগ্রেসের হলেও ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের l তাই সাহায্য করলেন সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেনদের l ১৯৬৭ এ ক্ষমতায় আসতেই শুরু হয়ে যায় জমি দখল l সাঁই বাড়ী হত্যাকান্ড অন্যতম l এরপরে সিদ্ধার্থ রায় এবং জ্যোতিবসু পরের দশ বছরে গ্রামের প্রভাবশালী বাঙালী হিন্দুদের তাড়ানো শুরু করেন এবং এর নাম দেয়া হয় প্রথমে ভূমি সংস্কার এবং পরে বর্গা l এই সময় জেলার পর জেলা জনবিন্যাস পাল্টাতে থাকে l স্বাধীনতার সময় শুধু মুর্শিদাবাদ এবং মালদায় সংখ্যালঘুরা ছিল l ময়ূরাক্ষী এবং ডিভিসি সেচ প্রকল্প হওয়ার পর ভূমি সংস্কারের সুবিধা নিয়ে এঁরা চলে আসে বর্ধমান এবং বীরভূমে l কংসবতী সেচ প্রকল্পে পুরো হতে এঁরা সিপিএম পার্টিকে ধরে চলে আসে বাঁকুড়া, মেদিনীপুর এবং হুগলীর কামারপুকুর অঞ্চলে l হিন্দুরা কিছুদিন পর কম দামে বাকী জমি বিক্রি করে গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকে l কারণ সস্য বিতরনের দায়িত্ব পার্টির হাতে চলে যায় l এরপরে ধানকল থেকে বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে পার্টি l কর্ম সংস্কৃতি এবং শিক্ষা ব্যাবস্থা খারাপ হতে, সরকারি বাবুরা তাঁদের পরিবার কলকাতা বা শিলিগুড়ির মত শহরে রেখে আসে l ফলে আরও সংকট বাড়ে l গ্রাম থেকে শহরে আসা শুরু করে হিন্দুরা l

২০০৪ এ প্রথমবার মুসলিম ভোট নিজের সংগঠন দেখায় এবং ধুয়ে মুছে যায় NDA l এই সময় থেকে শুরু হয় পঞ্চায়েত দখল, জমি ঘিরে ফেলে বিক্রি করতে বাধ্য করা l আর মোহনার দিকে জমিকে লিজে নিয়ে সেটাকে ভেরীতে পরিণত করা l এখন কথা হচ্ছে, এই অলিখিত চুক্তি চাষ কেন হত? এখানেই বাজার অর্থনীতির খেলা শুরু l বামপন্থীরা জমি ভাগ করে দেয়ায় চাষীদের পক্ষে উচ্চপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ অসম্ভব হয়ে পড়ে l তারা বাধ্য হয় l ভূমি সংস্কার ব্যর্থ হয় l কিন্তু এই চুক্তিতে সাহস তাঁরাই পেত যাদের ঐক্য আছে l

২০১১ তে ক্ষমতায় এসে, তৃণমূল প্রথমে কিছু সিপিএম নেতার জমি কেড়ে নেয় l পরে সেই খেলা ধরে নেয় শাহাজান, সাওকাতরা l তারা দল পাল্টায় l একদিকে, এমনভাবে বিধানসভা ডিলিমিটেশন হয় যে উত্তরবঙ্গের মোট যে কয়টা আসন, দুই ২৪ পরগনাতেও সেই কটা আসন l নদীয়া, মুর্শিদাবাদ এবং কলকাতা আগেই হিন্দু বাঙালীদের হাতের বাইরে চলে গেছেl ফলে ক্ষমতায় আসতে গেলে এই পাঁচটা জেলা পেলেই চলবে l আর এই সব জেলাতেই রাজনৈতিক ক্ষমতা শাহজাহানদের l

সঙ্গে শুরু হয় OBC কোটার খেলা l হক সাহেবের উত্তরাধিকারীরা জানেন, মূর্খ হিন্দু বাঙালী এই OBC এবং EWS এর খেলা বুঝবে না l ১৯৯০ তে পাশ হওয়া মণ্ডল কমিশন অনুযায়ী মাহিষ্য, সদগোপসহ তিন কোটি হিন্দু বাঙালী OBC কোটা পাওয়ার কথা l কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রথমেই ১০% OBC A নাম দিয়ে মুসলিমদের জন্য করে দেন l বাকী ৭% এ হিন্দু এবং মুসলিম প্রথমে সমান এবং পরে মমতা ব্যানার্জী এসেছে মুসলিমদের ভাগ বাড়িয়ে দেন l কিছুদিন আছে মমতা ব্যানার্জী ঘোষণা করেন, OBC কোটায় ৯৯% নাকি মুসলিমদের সংরক্ষণ দেয়া হয় l শুরু হল সরকারি পদ দখল l বিভিন্ন মিউনিসিপালিটিতে এবং পুলিশে সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে l ওদিকে ২০১৯ এ জেনারেল কাস্টের গরীবদের জন্য মোদীজি সংরক্ষণ দিলেও, সেই সার্টিফিকেট পাওয়া হিন্দুদের পক্ষে অসাধ্য l

মোহনায় ভেড়ির খেলাটা আরও একবার দেখা যাক l ধরা যাক একটা গ্রামে ২০০ বিঘা জমির মালিক ২০০০ জন l সবার কাছে সম্মতি আলাদা করে চুক্তি করা হল ১০ বছরের লিজ পাওয়ার জন্য l পরের বছর উঁচু জমি কেটে ভেরী বানানো হয়ে গেল l তৃতীয় বছর থেকে টাকা বন্ধ l এইবার চুক্তি বাতিল করে দিলে কোথায় পাওয়া যাবে তাঁদের সেই জমি? পুরো ২০০ বিঘা তো পুকুর হয়ে গেছে এবং চিংড়ি চাষ হয় l অর্থাৎ খেলা শেষ l ভিক্ষা করো শিয়ালদা স্টেশনে l ভিক্ষাশ্রী দেয়া হলে পেট চলে যাবে l

তাই আজ এঁরা সবাই ক্ষেপে l হক সাহেবের উত্তরসূরীরা জমি চুরিতে পিএইচডি করে এসেছে আর আমরা রবীন্দ্র নজরুল জীবনানন্দ নিয়ে নন্দনে সময় কাটাচ্ছি l

এখন বাঁচার একটাই রাস্তা l

আঁধারের সংগে স্থাবর সম্পত্তি এবং জমির মালিকানাকে ট্যাগ করা l পরের পাঁচ বছরেই করতে হবে l নইলে কিlন্তু গঙ্গার পূর্ব দিকে বাঙালীর থাকা মুশকিল l পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার পরিবর্তন হলেকোন কাজ শুরুর আগে কমকরে তিন ডজন আইন পাল্টাতে হবে l নইলে কাজ করা তো দূরের কথা কাজ শুরু করা যাবে না l জমি রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করতে হবে l গুগল বা TCS এর মত কোম্পানিকে কাজে লাগাতে হবে l

সুদীপ্ত গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.