১.
চতুর্বেদে (খ্রি. পূ. ৩৭০০-২০০০) নির্দিষ্টভাবে আমের উল্লেখ পাওয়া না গেলেও বৃহদারণ্যক-উপনিষদ (খ্রি. পূ. ১০০০) ও ‘শতপথ ব্রাহ্মণ ‘-এ অামের ভূয়সী প্রশংসা অাছে। মহাভারতে অামের টুকরো দিয়ে মাংস রাঁধার কথা আছে।
রামায়ণের একটি টেক্সট অনুযায়ী রাবণ শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতে অাম নিয়ে এসেছিলেন। মন্দির-স্থাপত্য থেকে জানা যায় হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনদের অতি পবিত্র ফল হচ্ছে অাম। হিন্দুদের বিশ্বাস প্রজাপতি ব্রহ্মার থেকে অামের উৎপত্তি। তাই অাম্র-পল্লব পাঁচটি পবিত্র পাতার অন্যতম। অাম্র-মঞ্জরীকে কামের দেবতা মদনদেবের পুষ্প-বাণের অন্যতম বলে মনে করা হয়।
কাঞ্চিতে অবস্থিত একাম্ব্রেশ্বর মন্দিরের প্রাচীন আমগাছে (সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো বলে কথিত) শিব-পার্বতীর অবস্থান বলে কথিত। এই প্রাচীন বৃক্ষের চারটি প্রধান শাখায় চারটি বিভিন্ন জাতের আম ফলে। সম্ভবত চারটি পৃথক জাতের পরশাখী চারটি বিভিন্ন এলাগাছে জুড়ে তাদেরকে পাশাপাশি লাগানো হয়েছিল। কালের গর্ভে তাদের গুঁড়ি পরস্পর জুড়ে গিয়ে একটি সাধারণ গুড়িতে পর্যবসিত হয় এবং পরবর্তীতে তারই সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে ফলছে অালাদা জাতের অাম।
ভগবান বুদ্ধ যে অামগাছের তলায় বিশ্রাম নিতেন এবং ধর্ম প্রচার করতেন, কালক্রমে সেটি বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র বৃক্ষের মান্যতা পায়। বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থে উল্লেখ অাছে অামের ফলন বাড়াতে অামগাছে দুগ্ধ -সেচ দেবার প্রচলন ছিল। জাতক গ্রন্থে উল্লেখ অাছে, অামের রস প্রস্তুতির প্রসঙ্গ। জৈন ধর্মগ্রন্থ বিশেষ করে ভগবান মহাবীর-পরবর্তী গ্রন্থে অামের বিশেষ উল্লেখ রয়েছে। অন্তত এক হাজারটি আমগাছ দিয়ে রচিত হয়েছিল পবিত্র জৈন-বনখন্ড। খি. পূ. ৫০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত জৈনধর্মগ্রন্থ ‘বৃহৎকল্প’ ও ভাষ্যে অাম পাকানোর চারটি পদ্ধতির উল্লেখ অাছে।
মহারাষ্ট্রের ‘মহানুভপন্থা’ নামক হিন্দু-গোষ্ঠীর প্রবর্তক চক্রধর স্বামী (১১৯৪-১২৭৪) ছিলেন ‘দত্তাত্রেয়’ নামক রূপক দেবতার উপাসক, যা অাদতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের একত্রিত, একদেহী দেব-মূর্তি। চক্রধর স্বামী ও তাঁর অনুগামী ভক্তেরা হাজার হাজার অামগাছ লাগিয়েছিলেন এবং মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ ও মারাথওয়ারা অঞ্চলে ‘দত্তাত্রেয়’র অজস্র মন্দির নির্মাণ করেন। এই রকম প্রাচীন কোনো কোনো অামগাছের সন্ধান অাজও মেলে, যেমন – ফুলাম্ব্রি (ঔরঙ্গাবাদ), নেকনুর (জেলা:বিদ), ভাশি (জেলা:ওসমানাবাদ)। ফুলাম্ব্রির অামবাগানে ১৯৩৬ সালে প্রাপ্ত অামগাছের সংখ্যা প্রায় ১.৩৫ লক্ষ।
আম্রবৃক্ষকে নানান দেব-দেবীর নামে অভিহিত করা হয়। গৃহের মূল প্রবেশদ্বারে আমের পাতা দিয়ে গাঁথা মালা টাঙানো থাকে, যাতে প্রবেশ পথ দিয়ে কোনো নেতিবাচক ঋণাত্মক শক্তি গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে। বৃষ্টির দেবতা বরুণ দেবকে তুষ্ট করে বৃষ্টি আনয়নের জন্য যজ্ঞাহুতি একপ্রকার ইমিটেটিভ ম্যাজিক। যজ্ঞকুণ্ডে ঘি-এ ডোবানো আম পাতা উৎসর্গ করা হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃততে আছে, “এক বাগানে দু’জন লোক বেড়াতে গেছে। তার ভিতর যার বিষয়-বুদ্ধি বেশি সে ঢুকেই বাগানে ক’টা আম গাছ, কোন গাছে কত আম হয়েছে, বাগানটির কত দাম হতে পারে, এই রকম বিচার করতে লাগলো, অপরজন মালির সঙ্গে ভাব করে গাছতলায় বসে একটি করে আম পাড়তে লাগলো আর খেতে লাগলো। এখন কে বেশি বুদ্ধিমান? আম খাও, পেট ভরবে, কেবল পাতা গুণে কিংবা হিসাব-কিতাব করে লাভ কী? যাঁরা জ্ঞানাভিমানী তাঁরা শাস্ত্রীয় মীমাংসা তর্কযুক্তি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, বুদ্ধিমান লোক ঈশ্বরের সঙ্গে ভাব করে এ-সংসারে পরমানন্দ ভোগ করেন।”
আম গবেষক হিসাবে এই বাণীটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, আমের সবচাইতে বড় গুণ হল, তার Organoleptic taste, স্বাদে-গন্ধে তার অপূর্বতা। আমের সব গবেষণাই হল, আমের জাত উদ্ভূত হল, বিজ্ঞানী ধন্য ধন্য হল, কিন্তু তা মানুষের রসনা পরিতৃপ্তি করছে কিনা — সেটাই মূল কথা! আম্র-শাঁসের পরমানন্দ আসলে আমাদের জিহবায়, আমাদের স্বাদকোরকের মর্মস্থলে। ঈশ্বরপ্রেমের পরমকথাও অন্তরের দিব্যানন্দে। যত হাইব্রিডই উদ্ভাবন করা হোক না কেন, মানুষের রসনা পরিতৃপ্তি আমের কোন জাতে আছে, তাই টিকে থাকবে। বাকী আম ও তার প্রজননবিদেরা পরে রইবেন বাহির বারান্দায়।
২.
নারকেলকে বলা হয় ‘কল্পবৃক্ষ’ অর্থাৎ স্বর্গের উদ্ভিদ। এর উপযোগিতা কেবল খাদ্য, পানীয় এবং আশ্রয়কেন্দ্রিক নয়। একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল যোগানদায়ী উদ্ভিদ হল নারকেল। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এর নৈকট্য এই সত্যের উপর প্রত্যয়িত যে নারকেল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা হয় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে।
প্রাচীন শাস্ত্রকারেরা বলছেন, “একো বৃক্ষো দশঃ পুত্র সমাচারেৎ।” অর্থাৎ এক বৃক্ষ দশ পুত্রের সমতুল্য। আমরা আন্দাজ করতে পারি মানুষ বৃক্ষ থেকে, বিশেষ করে কল্পবৃক্ষ থেকে কত উপকার গ্রহণ করলে এমন কৃতজ্ঞতায় কাব্য রচনা করতে পারেন।
গোয়া, দমন, দিউ এবং মহারাষ্ট্রের মানুষ নারকেল ফলকে ‘শিব’ বলে মনে করেন; কারণ খোসা ছাড়ানো নারকেল মালাই-এ তিনটি চোখ দেখা যায়, যা শিবের ত্রিনয়ণকে মনে করিয়ে দেয়।
ঐ অঞ্চলের মানুষ আগষ্ট-সেপ্টেম্বর বা ভাদ্র পূর্নিমা তিথিতে ‘নারকেল পূর্ণিমা’ পালন করে। সারা বছর সমুদ্রের দেবতা বরুণ এই অঞ্চলের মানুষদের মাছ দিয়ে বাঁচান। প্রতিদানে নারকেল পূর্ণিমায় এরা নারকেল ভেঙ্গে আরবসাগরের তীরে গিয়ে ‘সমুদ্র জাগায়’ আর নারকেল উৎসর্গ করে। এই আচারের উদ্দেশ্য দুটি — প্রথম, সমুদ্র বা বরুণ দেবের সঙ্গে মহাদেবের মিলন; দ্বিতীয় বরুণ দেবতার সন্তান মাছেদের সুষম আহার প্রদান। হ্যাঁ, এই পুণ্যদিনে সম্পূর্ণ ফল ও শাঁস — দুই-ই সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। ছোবড়া সহ গোটা ফল সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে একসময় দূর দিগন্তে পৌঁছে স্বাভাবিক নারকেল বন গড়ে উঠবে — এই ছিল উদ্দেশ্য। নারকেল ফাটিয়ে সমুদ্রপুজোতে সামুদ্রিক নানান প্রাণী ও মাছের খাবার হয়ে উঠবে তার মনোরম শাঁস — এ তো প্রকৃতিচর্যার এক অনন্য উৎসব। সেই প্রাচীন প্রথা মনে রেখেই তারই কাছাকাছি সময়ে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব নারকেল দিবস। অনেকটা প্রাচীন ঐতিহ্যকে নবনির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ বলে মনে হয়, New construction of myth or reconstruction of myth.
শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে রয়েছে, “নারকেল গাছের বালদে খসে যায়, কিন্তু দাগ থাকে। শরীর থাকতে আমিত্বও সেইরূপ একেবারে যায় না, একটু-না-একটু দাগ থাকে। কিন্তু এই যৎসামান্য আমিত্ব পুরুষকে পুনরায় সংসারে আবদ্ধ করতে পারে না।”
“মানুষের ভেতরে দুটো ‘আমি’ কাজ করছে। একটা ‘পাকা আমি’, আরেকটা ‘কাঁচা’। আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার ছেলে, আমার শরীর — এইটে ‘কাঁচা আমি’। যা-কিছু দেখছি যা-কিছু শুনছি কিছুই আমার নয়, এ-শরীর পর্যন্ত আমার নয়, আমি নিত্যযুক্ত জ্ঞান-স্বরূপ — এইটে ‘পাকা আমি’।”
৩.
বেলবৃক্ষকে বলা হয় শিবদ্রুম। কৈলাস ছেড়ে মা দুর্গা মর্ত্যধামে এসে সাময়িক আশ্রয় নেন পৃথিবীতে ‘শিবের ফ্ল্যাটবাড়ি’-তে; সেটা হল বিল্ববৃক্ষ। দুর্গাপূজার বোধনে সায়ংকালে সেই বেলগাছের সামনে গিয়ে বিল্বতরুকে আহ্বান করা হয় — “ওঁ মেরুমন্দর-কৈলাস-হিমবচ্ছিখরে গিরৌ। জাতঃ শ্রীফলবৃক্ষ ত্বমম্বিকায়াঃ সদা প্রিয়ঃ। শ্রীশৈলশিখরে জাতঃ শ্রীফলঃ শ্রীনিকেতনঃ। নেতব্যোহসি ময়গচ্ছ পুজ্যো দুর্গাস্বরূপতঃ।।” শিবের সঙ্গে বিল্ববৃক্ষের যোগ বৃক্ষপূজার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে আঠা লাগে না। তেমনি জ্ঞানলাভ করে সংসারে থাকলে কামিনী-কাঞ্চনের ময়লা লাগে না।”
বাংলায় একটি প্রচলিত প্রবাদ হল, “আগে দিয়ে বেড়া/তবে ধরো গাছের গোড়া।” শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে রয়েছে, “চারাগাছকে প্রথমে বেড়া দিয়ে রক্ষা করতে হয়, না-হলে ছাগল-গোরু এসে তাকে নষ্ট করে ফেলে। গাছ একবার বড়ো হলে আর সে ভয় থাকে না, তখন শত-শত গোরু-ছাগল এসে তার তলায় আশ্রয় নেয় ও তার পাতায় পেট ভরায়। সাধনার প্রথম অবস্থায় আপনাকে কুসঙ্গ, বিষয়বুদ্ধি ও সংসার ইত্যাদি থেকে রক্ষা করতে হবে, না-করলে সমুদয় ধর্মভাব নষ্ট করে ফেলবে। কিন্তু একবার সিদ্ধ হলে আর কোনো ভয় নেই। হাজার-হাজার সংসার ও কুসঙ্গ তখন তোমায় নষ্ট করতে পারবে না, বরং অনেকে তোমার কাছে এসে শান্তি পাবে।”
ভারতবর্ষও বৃহত্তর অর্থে একটি বাগান, মালঞ্চ, কুসুমোদ্যান। এক এক জন যথার্থ ভারতীয় তার কুসুম-কোমল জীবন-বৃক্ষ। দেশের সকল মানুষকে বাঁচাতে তাই রাষ্ট্রীয় বেড়া দিতে হবে। যখন ভারতবর্ষ নিরাপত্তার বেড়ার মধ্যে থেকে, বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে দেশের মানুষের সার্বিক বিকাশ ঘটাবে তখনই দেশ এবং দেশবাসী বিশ্বের সকল শোষিত ও নিঃস্ব মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে সক্ষম হবে। বিশ্বের কল্যাণের জন্যই ভারতবর্ষীয় বাগান রক্ষা করতে হবে। বিশ্বের মঙ্গলের জন্যই রাষ্ট্রীয় বেড়া দিতে হবে। কারণ ভারতীয় দর্শন সারা বিশ্বের মানুষকে ‘অমৃতের পুত্র’ বলে সম্বোধন করে। আগে দেশ ও মানুষ বাঁচুক, তবে বিশ্ব বাঁচাবে! আগে ভারতবর্ষ আপন সৌকর্যে পথ চলুক, তবে সে হাঁটা পথে বিশ্ববাসী চলবে, মঙ্গলময় বিশ্ব রচিত হবে।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী