আশুতােষ মুখােপাধ্যায়ের পুত্র শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবন ও আরও নানান আঙ্গিক নিয়ে প্রভূত আলােচনা হলেও একজন প্রাজ্ঞ শিক্ষাবিদ হিসেবে, একজন সুদক্ষ উপাচার্য হিসেবে তার সম্পর্কে আলােচনা খুব কমই লক্ষ্য করা যায়। শ্যামাপ্রসাদ কম বয়স থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি ভবানীপুর মিত্র ইন্সটিটিউশন থেকে সরকারি বৃত্তিসহ প্রথম শ্রেণীতে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেন ১৯১৭ সালে। ১৯১৯ সালে আইএ পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স-সহ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বিএ পাশ করেন ১৯২১ সালে। আইএ ও বিএ দুটি পরীক্ষাতেই বাংলাতেও প্রথম হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র রৌপ্য ও স্বর্ণ পদক পারিতােষিক লাভ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গভাষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এমএ পাশ করেন ১৯২৩ সালে। বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বড় দা রমাপ্রসাদ ও শ্যামাপ্রসাদ দু’জনের উৎসাহে বাড়ি থেকে মাসিক ‘বঙ্গবাণী’ সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। এই পত্রিকাতেইশ্যামাপ্রসাদ সাহস করে প্রথম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবি’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে থাকেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে বিএল পাশ করেন এবং কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভােকেট হন। ১৯২৬-এ তিনি লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে যান এবং সাফল্যের সঙ্গে ব্যারিস্টারি পাশ করে পরের বছরই ফিরে আসেন।
শ্যামাপ্রসাদ ১৯২৪ -এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফেলাে নির্বাচিত হন। এই বছরই মে মাসে স্যার আশুতােষের মৃত্যুর পর সিন্ডিকেটের শূন্য আসনে সদস্যরূপে মনােনীত হন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ার সময় তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সম্মেলনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৩৪-এ মাত্র ৩৩ বছর বয়সে স্যার আশুতােষের মৃত্যুর (১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে) প্রায় দশ বছর পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে মনােনীত হন। ১৯৩৮ পর্যন্ত টানা চার বছর তিনি ছিলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পিতা আশুতােষের শিক্ষা সংক্রান্ত আদর্শ ও লক্ষ্যগুলি কার্যে পরিণত করতে শুরু করেন। বিজ্ঞান-সাধক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় শ্যামাপ্রসাদকে লেখা এক পত্রে লিখেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ কাজে তুমি দেখিতেছি ‘বাপকা ব্যাটা হইয়াছ। কেননা এত অক্লান্ত পরিশ্রম ও স্বার্থত্যাগ কেহই করিতে রাজি নয়।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দান করার জন্য অনুরােধ জানান। এই সমাবর্তন উৎসবে রবীন্দ্রনাথ প্রথা ভঙ্গ করে বাংলায় তাঁর বিখ্যাত ভাষণ দেন। উচ্চশিক্ষা প্রসারে শ্যামাপ্রসাদ মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার পক্ষ পাতী ছিলেন। অল্পকালের মধ্যেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে তার নাম সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বাের্ডের সদস্য ও পরে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ভাষণ দেওয়ার জন্য ও কমিটির সদস্য হওয়ার জন্য তাঁর কাছে অনুরােধ আসতে থাকে। ১৯৩৫ সালে শ্যামাপ্রসাদ ব্যাঙ্গালােরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সের কোর্ট ও কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক নিখিলেশ গুহ (মিল অমিল- জাতীয় আন্দোলনে শ্যামাপ্রসাদ ও সুভাষচন্দ্র’, ‘ইতিকথা’, সপ্তম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, জুলাই, ২০১৯, পৃষ্ঠা-১৭১-১৮৭) লিখেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের অন্যতম কৃতিত্ব হলাে—(১)কৃষিশিক্ষার ব্যবস্থা, (২) বিহারীলাল মিত্রের অর্থানুকুল্যে মেয়েদের জন্য হােম সায়েন্স কলেজ প্রতিষ্ঠা ও হােম সায়েন্স শিক্ষার ব্যবস্থা, (৩) আশুতােষ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা এবং (৪) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সামনে রেখে বাংলা বানানের সমতা এবং বাংলায় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা প্রণয়ন। শেষােক্ত লক্ষ্যে দুটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহ-রেজিস্ট্রার ড. দীনেশচন্দ্র সিংহের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি হলাে– বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস সাড়ম্বরে উদযাপন, বাংলা বানান সংস্কার, বাংলা পরিভাষা সমিতি গঠন, রবীন্দ্রনাথকে বাংলা ভাষায় সমাবর্তন ভাষণদানে আহ্বান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক চিহ্নের পরিবর্তন ইত্যাদি।
শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়ের ইচ্ছা ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিক পরিমাণে যুক্ত করার। আশুতােষের অনুরােধে কবি। ইতিপুর্বে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরে বাংলার প্রশ্নপত্র রচনা করেন। কবির নােবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ প্রকাশের পূর্বেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে সাম্মানিক ডক্টর অব লিটারেচার উপাধিতে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয়েছিল। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত রীতি লঙ্ঘন করে শ্যামাপ্রসাদের অনুরােধে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি বদলে বাংলায় ভাষণ দিতে গিয়ে সেই কথা স্মরণ করে বলেন— “বিশ্ববিদ্যালয়ের দীক্ষামন্ত্র থেকে বঞ্চিত আমার মতাে ব্রাত্য বাংলা লেখককে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি দিয়ে আশুতােষ প্রথম রীতি লঙ্ঘন করেছেন, আজ তাঁরই পুত্র সেই ব্রাত্যকেই আজকের দিনের অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষায় অভিভাষণ পাঠ করতে নিমন্ত্রণ করে পুনশ্চ সেই রীতিরই দুটি গ্রন্থি একসঙ্গে যুক্ত করেছেন। এতে বােঝা গেল বাঙ্গলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে ঋতু পরিবর্তন হয়েছে, পাশ্চাত্য আবহাওয়ায়। শীতে আড়ষ্ট শাখায় আজ এল নবপল্লব উৎসব।” কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহ-রেজিস্ট্রার ড. দীনেশচন্দ্র সিংহ তাঁর শ্যামাপ্রসাদ বঙ্গবিভাগ ও পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৫১) লিখেছেন, “মুসলমান ছাত্ররা সেই সমাবর্তন বয়কট করে কবির প্রতি অসৌজন্য প্রকাশেও পিছপা হয়নি।”
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার প্রতীক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক চিহ্নটি পরিবর্তন করার ব্যাপারে বেশ কিছুকাল ধরেই আলাপ-আলােচনা চলছিল। অনেক কমিটি, মিটিং, বৈঠক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত জানার পর প্রস্ফুটিত পদ্মফুলের ওপর বাংলায় ‘শ্রী” অক্ষর শােভিত প্রতীক চিহ্নটি গৃহীত ও প্রচলিত হয়। ১৯৩৭-এ অখণ্ড বঙ্গে মুসলিম লিগের সরকার গঠিত হয়। তারা এই ‘শ্রী’ ও ‘পদ্ম’-কে ইসলাম-বিরােধী বলে অভিহিত করে। ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক চিহ্ন থেকে শ্রী ও পদ্ম সরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৩৮-এর আগস্ট মাসে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়ের উপাচার্য পদের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লিগ সাফল্যের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় চালানাে সত্ত্বেও তাকেই পুনর্নিয়ােগ না করে শিক্ষার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এক মুসলমান উপাচার্য নিয়ােগ করে। ফলে প্রশাসন। ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থারও সাম্প্রদায়িকরণের পথও প্রশস্ত হয়।
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়