২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত পরেই বামপন্থী ঘরানার এক প্রবীণ সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞাসা করেন— কংগ্রেসের অবস্থা কেন এমন হয়েছে? এটা একটি অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন ছিল। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম— ‘কংগ্রেসের পুরো নাম কী?’ তিনি এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিছুটা ভেবে বললেন— ‘ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কংগ্রেস।আমি বললাম—‘ভারতীয়র অর্থ তো হলো সম্পূর্ণ ভারতব্যাপী’ আর ‘ভারতের জন্য। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শব্দের অর্থ কী?” তিনি কিছু বলতে পারলেন না। আমিই আগবাড়িয়ে বললাম ভারতীয় পরিভাষায় রাষ্ট্র শব্দের অর্থ হয় ‘সমাজ। ভারতীয় সমাজের কিছু বৈশিষ্ট্য হাজার হাজার বছরের পরম্পরার কারণে তার পরিচিতি নির্মাণ হয়ে গেছে। এই পরিচিতিকে অক্ষুন্ন রাখা ও পুষ্ট করার অর্থ হলো ভারতীয় হওয়া। প্রতিষ্ঠার ২০ বছর পর কংগ্রেস ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ নেয়। তখন কংগ্রেসের সমস্ত নেতা রাষ্ট্রীয় ভাবধারার ছিলেন। এই রাষ্ট্রের অর্থাৎ ভারতের পরম্পরাগত সমাজের বিশেষ পরিচিতি যা শত শত বছরের যাত্রার কারণে নির্মাণ হয়েছে এবং বহু আক্রমণ ও সংঘর্ষের পরও টিকে। রয়েছে, তার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কংগ্রেসের সেইসব নেতা গর্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
ভারতীয় চরিত্রের চারটি লক্ষণ :
ভারতীয় সমাজের একটি ভাবাত্মক আদর্শ রয়েছে, যার ভিত্তি হলো আধ্যাত্মিক। এই কারণে হাজার হাজার বছরের ঐতিহাসিক যাত্রার সময়কালে ভারতের এক চরিত্র নির্মাণ হয়েছে এবং এই আধ্যাত্মিকতার কারণে তার প্রকৃতিও নির্মাণ হয়েছে। ভারতের বিশাল ও ভৌগোলিক ক্ষেত্রে বসবাসকারী জনসমুদায়, বিভিন্ন জাতি-পন্থ- ভাষার নামে পরিচিত এই সম্পূর্ণ সমাজ ভারতের এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে সজ্জিত করে রেখেছে।
ভারতীয় চরিত্রের চারটি দিক রয়েছে। প্রথম, এক সদ বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি। ঈশ্বরের নাম এবং তার কাছে পৌঁছনোর পথ আলাদা আলাদা হলেও তা এক ও সমান। ভারত তার আচরণের দ্বারা এটি প্রমাণ করেছে। এজন্যই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর চিকাগো ভাষণে বলেছিলেন যে, আমরা কেবল অন্য ধর্মাবলম্বীর মত সহ্য করি তা নয়, আমরা সকল ধর্মকেই সত্য বলে বিশ্বাস করি, স্বীকার করি। তিনি আরও বলেন, ‘সংস্কৃত ভাষায় ইংরেজি‘এক্সক্লশান’শব্দটির কোনোমতে অনুবাদ করা যায় না, আমি সেই ধর্মর্ভুক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। দ্বিতীয় দিক হলো, বৈচিত্র্যের মূলে যে ঐক্য তাকে অনুভব করা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “বহুর মধ্যে ঐক্যের উপলব্ধি, বিচিত্রের মধ্যে ঐক্যস্থাপন—ইহাই ভারতের অন্তর্নিহিত ধর্ম। ভারতবর্ষ পার্থক্যকে বিরোধ বলিয়া জানে না, সে পরকে শত্রু বলিয়া কল্পনা করে না। এই জন্যই ত্যাগ না করিয়া, বিনাশ না করিয়া, একটি বৃহৎ ব্যবস্থার মধ্যে সকলকেই সে স্থান দিতে চায়। এই জন্য সকল পন্থাকে সে স্বীকার করে, স্বস্থানে সে। সকলেরই মাহাত্ম্য দেখিতে পায়। ভারতবর্ষের এই গুণ থাকাতে, কোনো সমাজকে আমাদের বিরোধী কল্পনা করিয়া আমরা ভীত হইব না। প্রত্যেক নব নব সংঘাতে অবশেষে আমরা আমাদের বিস্তারেরই প্রত্যাশা করিব।… তবে ভারতবর্ষের মধ্যে যে মৃত্যুহীন একটি শক্তি আছে, তাহার সন্ধান পাইব।” তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, ভারত বিশ্বাস করে নারী বা পুরুষ প্রত্যেকেই ঈশ্বরের অংশ। আর মনুষ্য জীবনের উদ্দেশ্য হলো তার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে সুপ্ত দেবত্বকে প্রকাশ করা। এরজন্য ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ— এই চার পুরুষার্থের কল্পনা ভারত করেছে। এখানে অর্থ ও কামের নিষেধ নেই। ধর্মর্সম্মত পথে তার পূর্ণ উপযোগ করে ‘মুক্ত থাকাকে এখানে পরিপূর্ণ অথবা সার্থক জীবন বলে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ দিক হলো, এখানে প্রত্যেক ব্যক্তির মুক্তিলাভের পথ অন্বেষণ করার স্বাধীনতা রয়েছে। আমার রুচি ও প্রকৃতি অনুসারে আমি কর্মপথ, ভক্তিপথ, ধ্যান অথবা জ্ঞানপথের যে কোনো একটি অথবা সবগুলিই একসঙ্গে গ্রহণ করতে পারি। আমার ইচ্ছা, রুচি ও ক্ষমতা অনুসারে এই চারটি পথই গ্রহণ করার স্বাধীনতা ভারত আমাকে দিয়েছে। এজন্যই এখানে, ভারতে আধ্যাত্মিক গণতন্ত্র রয়েছে বলা হয়।
কথাবার্তায় যে বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল তা হলো ভারত, তার পরিচিতি, তার স্বরূপ এবং রাষ্ট্র শব্দের বিস্তারিত ব্যাখ্যা।
ধর্মই ভারতের প্রকৃতি :
ভারতের প্রকৃতি হলো ধর্ম। এই ধর্ম ‘রিলিজিয়ন’অথবা উপাসনা পদ্ধতি নয়। নিজের অনুভূতির বিস্তার করে, আপনত্বের সীমা বিস্তৃত করে, যাকে একান্ত নিজের (যে রূঢ়ার্থে নিজের নয়) মনে হয়, তার জন্য, তার ভালোর জন্য কিছু করাই হলো ধর্ম। কোনো চিহ্ন ধারণ করা, কোনো বিশেষ পরিচিতি বহন করা বা তার প্রদর্শন করাই ধর্ম নয়; বরং প্রত্যক্ষ কাজ করা, সেই অনুসারে আচরণ করাকে আমাদের এখানে ধর্ম বলা হয়েছে। এর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে—মন্দিরে যাওয়া, বিগ্রহের পূজা করা, ব্রত রাখা ইত্যাদি ধর্ম নয়; এগুলি উপাসনা। উপাসনার ফলে ধর্মাচরণ করার শক্তি উৎপন্ন হয়। এজন্য বলা হয় উপাসনা ধর্মের জন্য; ধর্ম নয়। ধর্ম সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতি আপনত্ব বোধ শেখায়। ধর্মের এই ধারণাটি ভারতের নিজস্ব। ভারতের প্রতিটি ভাষায় অভিজাত ও লোকসাহিত্যে এর বিপুল বর্ণনা রয়েছে। ভারতের বাইরের কোনো ভাষায় ধর্মের সমার্থবোধক শব্দ নেই। এজন্য ইংরেজিতে বলার সময় ‘ধর্ম’ শব্দেরই প্রয়োগ করা ঠিক হবে। একে রিলিজিয়ন বললে ভুল হবে। উপাসনা পদ্ধতিকে রিলিজিয়ন বলা যেতে পারে।
চোখ খুলুন এবং ‘আমি’-কে ছোটো করুন, তাহলে আমরা’-র পরিধি বড়ো হয়ে যাবে। এই‘আমরা’-র পরিধি বড়োহতে হতে আমি বিলীন হয়ে আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, গ্রাম, জেলা, রাজ্য, দেশ, মনুষ্য সমাজ, পশু – পক্ষী, প্রকৃতি-পরিবেশ, সম্পূর্ণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ক্রমশ পরিব্যাপ্ত হয়ে যাবে।
ঈশ্ববাস্যমিদং সবং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্।
এই ভাব ও অনুভূতির মূল হলো আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক আপনত্ব। গাছপালা, বন্যপ্রাণী সমস্ত কিছু আমাদের নিজের বলে মনে হয়। এটা এই ভাবনার অভিব্যক্তি।
বিদ্যার্থীদের শিক্ষা দেওয়া, তৃষ্ণার্তকে জল দেওয়া, ক্ষুধার্তকে অন্ন দেওয়া, নিরাশ্রয়কে আশ্রয়, রোগীকে চিকিৎসা দান— এ সবই ধর্মীয় কাজ মনে করা হয়। এজন্য ধর্মশালা, ধর্মার্থ হাসপাতাল ইত্যাদি শব্দের প্রচলন হয়েছে। তীর্থস্থানে জলাশয়ের ঘাট নির্মাণ, জলাশয় নির্মাণ, রাস্তার ধারে গাছ। লাগানো, শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষকে সহায়তা দান—এসব কর্তব্য কর্মকে ধর্ম বলা হয়। এজন্য ধর্মের এক পরিভাষা কর্তব্য বা দায়িত্ব করা যেতে পারে। ধর্ম মানে ভেদভাব না করে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করা।
ভগিনী নিবেদিতা বলেছেন, যে সমাজে লোকেরা নিজের পরিশ্রমের দ্বারা অর্জিত অর্থ নিজের কাছে না রেখে সমাজহিতে দান করেন, সেই সমাজ একত্রিত অর্থের শক্তিতে সম্পন্ন ও সমৃদ্ধ হয়। ফলস্বরূপ, সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পন্ন ও সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু যে। সমাজে লোকেরা তাদের পরিশ্রমলব্ধ অর্থ। সমাজহিতে দান না করে নিজের কাছেই রেখে দেয় সেই সমাজের কিছু লোক সম্পন্ন ও সমৃদ্ধ হলেও সমাজ দরিদ্রই থেকে যায়।
সহায়তা করার সময় যদি ভেদভাব এসে যায়, তা ধর্ম’হতেই পারে না। ধর্ম সমাজকে সংযুক্ত করে, সংযুক্ত করে রাখে। এজন্য ধর্মের আর একটি পরিভাষা হলো ‘যা ধারণ করে রাখে, তাই ‘ধর্ম। বলা হয়েছে‘ধারণাধর্মমিত্যাহুঃ ধর্মো ধরায়তে প্রজাঃ। সমাজ থেকে আমরা যা কিছু গ্রহণ করি, তার চেয়ে বেশি সমাজকে প্রদান করলে ধর্ম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কন্যাকুমারী বিবেকানন্দ কেন্দ্রের প্রার্থনায় এক শ্লোক রয়েছে‘জীবনে যাবদাদানং স্যাৎ প্রদানং ততোধিক। ইত্যে প্রার্থনাস্মাকং ভগবন্ পরিপূৰ্যতাম।অর্থাৎ ‘জীবনে যা কিছু গ্রহণ করি, তার চেয়ে অধিক যেন সমাজে প্রতিদান করতে পারি। হে ভগবান! আমাদের এই প্রার্থনা পূরণ কর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে স্পষ্ট বলেছেন যে, কল্যাণকারী রাজ্য ভারতীয় ধারণা নয়। তিনি বলেছেন, যে সমাজ নিজের আবশ্যকতার জন্য রাজ্যের ওপর যত কম নির্ভর করে থাকে তাকে স্বদেশি সমাজ বলা হয়। এজন্য ভারতে সামাজিক উদ্যোগ ও সামাজিক অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। এর ব্যবস্থা ‘ধর্ম’ করে চলেছে। এজন্যই আমাদের সমাজ ধর্মাধিষ্ঠিত ছিল। এবং থাকবে; ধর্মনিরপেক্ষ নয়।
ধর্মচক্র প্রবর্তনায় :
ভারতের সংবিধান তৈরির সময় সংবিধান সমিতির সদস্যদের এই ‘ধর্ম শব্দটির যথাযথ ধারণা ও জ্ঞান ছিল— এটি পরিষ্কার বোঝা গিয়েছে। এজন্য ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের ধ্যেয়বাক্য ‘যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ’, সংসদভবনে ‘ধর্মচক্র প্রবর্তনায়’, রাজ্যসভায় ‘সত্যং বদ ধর্মং চর’ লেখা রয়েছে। শুধু এগুলিই নয়, আমাদের জাতীয় পতাকায় যে চক্র অঙ্কিত রয়েছে তা ‘ধর্মচক্র’
চক্র ঘূর্ণায়মান হয়ে থাকে। অর্থাৎ সতত ভ্রমণশীল প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্ম’আচরণ করা, সমস্ত সমাজ এক, আমার নিজের এই ভেবে কোনো প্রকার ভেদভাব না করে সমাজকে দিতে থাকা একান্ত আবশ্যক। ধর্মচক্রকে ঘূর্ণায়মান রাখতে সহযোগিতার জন্য প্রতিটি কাজ তা ছোটো-বড়ো যাই হোক না কেন প্রত্যেককে এই কাজ করতেই হবে।
১৯৮৮-তে গুজরাটের কিছু অংশে ভীষণ আকাল পড়েছিল। তখন আমি ভদোদরা জেলা প্রচারক ছিলাম। আকাল-পীড়িত এলাকায় পাঠানোর জন্য প্রত্যেক বাড়ি থেকে ‘সুখড়ী’ (এক প্রকার পুষ্টিকর খাদ্য) সংগ্রহ করে সঙ্ঘ কার্যালয়ে জমা করা হচ্ছিল। একদিন লাঠিতে ভর দিয়ে এক বৃদ্ধা ভিখারিনি ওখানে আসে। সেখানকার কার্যকর্তারা যখন তাকে এখানে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করে তখন অত্যন্ত ক্ষীণস্বরে সে বলে ‘সুখ-ড়ী। কার্যকর্তারা তাকে বলে যে, এই সুখড়ী দুর্ভিক্ষগ্রস্ত মানুষদের কাছে পাঠানোর জন্য, এখানকার লোকের জন্য নয়। তখন সেই বৃদ্ধা তার পরনের কাপড়ের মধ্যে থেকে একটা পুঁটলি বের করে দিতে দিতে বলে, “বেটা ! আমি নিতে আসিনি, দিতে এসেছি। সে তার সারাদিনের ভিক্ষার থেকে কিছুটা সুখড়ী। বাড়িতে তৈরি করে দিতে এসেছিল। এরকম ছোটো ছোটো কাজের দ্বারা ধর্ম পরিপুষ্টহয়। ধর্মচক্র সচল থাকে।
কয়েক বছর আগে তামিলনাড়ুর তিরুপুর শহরে ‘সক্ষম’ সংস্থার উদ্যোগে কেন্দ্র সরকারের সহযোগিতায় দিব্যাঙ্গ সহায়তা শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল। সক্ষম দিব্যাঙ্গদের জন্য কাজ করা সদ্য অনুপ্রাণিত একটি সংগঠন। দিব্যাঙ্গদের সহায়তা এবং কিছু উপকরণ দেওয়ার জন্য শিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল। সহায়তা প্রদানের । আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজ চলছিল। অসংখ্য দিব্যাঙ্গ ভাই -বোন বাসগুমটি থেকে আসছিল। তাদের নিয়ে আসা এক অটোচালক ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখতেই তার সহানুভূতি জাগ্রত হয়ে পড়ে। তারপর থেকে। সে সারাদিন শিবিরে আসা-যাওয়ার জন্য। দিব্যাঙ্গদের থেকে কোনো ভাড়াই নেয়নি।
রাষ্ট্রের হিন্দু হওয়া : ভারতের মতাদর্শগত অধিষ্ঠানের কারণেই তার চরিত্র ও প্রকৃতি নির্মাণ হয়েছে। সারা বিশ্ব একে ‘হিন্দুত্ব’ নামে জানে। এজন্য ভারতের, ভারতীয় সমাজের অর্থাৎ এই রাষ্ট্রের পরিচিতি ‘হিন্দু হিসেবে। এই অর্থে এই সমাজ হিন্দুরাষ্ট্র। এই হিন্দুত্ব সবাইকে নিয়ে চলা, সবাইকে যুক্ত করা, কারো সঙ্গে ভেদভাব করা নয় এবং ভবিষ্যতেও এরকমই থাকবে। হিন্দুত্ব এই রাষ্ট্রের বিশেষণ। হিন্দুত্ব সমস্ত ভারতীয়ের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ব্যবসায়িক এবং সামাজিক জীবনে অভিব্যক্ত হওয়া, সহজ আচরণে আনা অর্থাৎ এই রাষ্ট্রের ‘হিন্দু হওয়া। সামাজিক সমৃদ্ধিকে বৃদ্ধি করে তার বিনিয়োগ কোনো প্রকার ভেদভাব না করে সমস্ত অভাবগ্রস্ত লোকের জন্য হবে— এরকম ধর্মসম্মত আচরণ করাই হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া। আমাদের পূর্বপুরুষ, বীরপুরুষ, সমাজ সংস্কারক এবং সাধুসন্তদের কারণে বহু আক্রমণ ও সংঘর্ষের সম্মুখীন হওয়া এই রাষ্ট্রীয় প্রবাহ অবিরত চালাতে থাকা, তার সম্মান করাই ‘হিন্দ’ হওয়া।
ভারতের পবিত্র ভূমিতে যে শ্রেষ্ঠ দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে, দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, দৃঢ় হয়েছে। এবং যে শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে সেই ভারতভূমিকে মাতৃস্বরূপা মনে করে তাকে ভক্তি করাই ‘হিন্দু হওয়া। এই কাজ কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা সরকারের নয়। এই কাজ এই সমাজের প্রত্যেক সন্তানের। ‘সর্বেহপি সুখিনঃ সন্তু সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ। সর্বেভদ্রানি পশ্যন্ত মা কশ্চিৎ দুঃখমাপুয়াৎ৷৷ এই ‘অপি’-তে বালক-বালিকা, যুবক-বৃদ্ধ, রুগ্ন, দুর্বল, গুণহীন সবাই রয়েছে। এরা সবাই সুখী হোক— এর গ্যারান্টি ধর্ম দিয়ে থাকে। এর আচরণ প্রত্যেককে করতে হবে।
ব্যক্তির রাষ্ট্রীয় হওয়া :
এই ভারতের সম্পূর্ণ সমাজ এক, আমার নিজের। সবাই সমান এবং আমাকে আমার সমাজকে কর্তব্যবোধে নিজের মনে করে দিয়ে যেতে হবে—এরকম ভাবনা ও আচরণ করার অর্থ হলো হিন্দু হওয়া অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় হওয়া। আমরা হিন্দু হওয়ার কারণে এই সমাজ হিন্দুরাষ্ট্র। এটি কালাতীত সত্য। আমাদের হিন্দুরাষ্ট্র বলার এটাই অর্থ। এতে কারো ক্ষোভ অথবা অপমানিত হওয়ার, কাউকে ভীত সন্ত্রস্ত হওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ, বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা, বিভিন্ন উপাসনা পদ্ধতি অনুসরণকারী এই যে ভারতের রাষ্ট্রীয় সমাজ, আমরা সবাই এক, বিবিধতায় বিভেদ সৃষ্টি না করা আমাদের বৈশিষ্ট্য—এটি মেনে নিয়ে পৃথিবীতে আনন্দ, সৌহার্দ্য ও সামঞ্জস্যের সঙ্গে বছরের পর বছর বেঁচে আছে।
যাতায়াত ও বার্তা প্রেরণের আধুনিক উপকরণের কারণে এখন বিশ্ব খুবই নিকটে এসে গেছে। বিশ্বে ভাষা, বংশ, উপাসনা (রিলিজিয়ন) পদ্ধতির বিবিধতা থাকবেই। এই বিবিধতার মূলে যে ঐক্য তা দেখার দৃষ্টি ভারতের রয়েছে। কারণ, ঈশাবাস্যমিদং’ ভারতের ধ্যেয়বাক্য।‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ এবং মা গৃধঃ আচরণ সূত্র। এর কারণে ধর্মকে দৃঢ় করলেই সকলের সুখের ব্যবস্থা হতে পারে।
বহু শতক ধরে ভারত এ করে আসছে। এজন্য ভারত ‘বসুধৈব কুটুম্বক’ ও ‘বিশ্বং ভবত্যেক নীড়’-এর প্রতিষ্ঠা করেছে। ভারত তার হিন্দুত্বের পূর্ণ আচরণ করে এর উদাহরণ সৃষ্টি করবে যে বৈচিত্র্যময় ও বিশ্বব্যাপী মানবগোষ্ঠীর জন্য সৌহার্দ্য ও সহাবস্থানের সঙ্গে একত্রে কীভাবে বেঁচে থাকতে পারে, কীভাবে চলতে পারে। এটি ভারতের কর্তব্য এবং বিশ্বের আবশ্যকতাও বটে। এরকম ভারত নির্মাণ মানে ভারতবর্ষের বিশ্বগুরু হওয়া। শুধু ঘোষণা করলেই গুর হওয়া যায় না, আচরণের দ্বারা তা প্রমাণ করতে হয়। এই শ্রেষ্ঠতম কাজেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ লেগে রয়েছে। এটিই সঙ্রে উদ্দেশ্য আর তার সৃষ্টি হওয়ার কারণ। সঙ্ শুরুর সময়ের একজন প্রচারক সঙ্ঘের বিষয়ে যা বলেছিলেন তা অত্যন্ত সার্থক ও অর্থবহ। তিনি বলেছিলেন, এই হিন্দুরাষ্ট্রের অর্থাৎ হিন্দুসমাজের জীবনোদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য তাকে সক্ষম ও বিকশিত করার কাজ হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।
রাষ্ট্রীয় বা রাষ্ট্রবাদী :
কিছু লোক এই ‘রাষ্ট্রীয়’-কে রাষ্ট্রবাদী বলে অভিহিত করেন যা অনুচিত।‘রাষ্ট্রবাদ’ শব্দ ও ধারণা ভারতীয় নয়। ষোড়শ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যে যে রাষ্ট্র ধারণাটি তৈরি হয়েছিল তা ভারতীয় রাষ্ট্র’ ধারণা থেকে একেবারে ভিন্ন। সেখানে রাষ্ট্র হলো রাজ্যভিত্তিক এবং তারা তাদের রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করেছে, আক্রমণ করেছে, অত্যাচার করেছে, এমনকী নির্যাতন পর্যন্ত চালিয়েছে। ভারতীয় রাষ্ট্র ধারণা রাজ্যভিত্তিক নয়; সমাজভিত্তিক। এর মূলে রয়েছে এক সংস্কৃতি অথবা সমান জীবন দৃষ্টিভঙ্গি। এজন্য। রাজ্য অনেক ও বিবিধ হওয়া সত্ত্বেও এই সমাজ অর্থাৎ রাষ্ট্র নিজের জীবনদৃষ্টির ভিত্তিতে সাংস্কৃতিকভাবে এক। এ কারণেই এখানে রাষ্ট্রীয়তার ধারণা পরিপুষ্ট হয়েছে; রাষ্ট্রবাদ নয়। স্বাধীনতাপূর্বকালখণ্ডে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কংগ্রেসের বেশিরভাগ নেতা এবং অসংখ্য কর্মী রাষ্ট্রীয়’মনোভাবাপন্ন ছিলেন। পরে কংগ্রেসে কমিউনিজমের প্রভাব বৃদ্ধির ফলে এই ‘রাষ্ট্রীয় নেতত্বকে কোণঠাসা করে দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস দল ভাঙনের কারণে এই প্রক্রিয়া পূর্ণ হয়ে, কমিউনিস্ট ভাবধারার পূর্ণ প্রভাবে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসা অথবা ক্ষমতায় টিকে থাকার যাত্রা কংগ্রেসে শুরু হয়। এই সময়েই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সদ্য এবং সাধুসন্তদের প্রয়াসে ‘রাষ্ট্রভাব জাগরণের কাজ দ্রুতগতিতে হতে শুরু করে এবং তার প্রভাব তখন সমাজে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। একদিকে রাষ্ট্রীয়’ জাগরণের কাজ চলছিল, যার কারণে সমাজে জাতি, পন্থ, প্রান্ত, ভাষা ইত্যাদি পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির ভাবনা ও আচরণ বৃদ্ধি পাচ্ছিল, অন্যদিকে কংগ্রেস দল জাতপাত, প্রদেশ, ভাষা ইত্যাদিতে ভেদ সৃষ্টি করে, মানুষের মনোভাবনাকে বিভ্রান্ত করে, শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বা ক্ষমতা লাভের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল।
এর ফলস্বরূপ, ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কংগ্রেস ‘রাষ্ট্রীয়তা’ থেকে দুরে সরে যায় এবং রাষ্ট্র জাগরণের কারণে রাষ্ট্রীয় ও জাগ্রত জনসমাজ কংগ্রেসকে একেবারে কিনারায় পাঠিয়ে দেয়। এই প্রবন্ধের শুরুতে বামপন্থী ঘরানার ওই প্রবীণ সাংবাদিক সম্পাদকের জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ‘কংগ্রেসের অবস্থা কেন এমন হলো? তার উত্তর এটিই।
ড. মনমোহন বৈদ্য
(লেখক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সহ-সরকাৰ্যৰ্বাহ)
2020-01-17