পরিবেশ বিজ্ঞানের পাঠ নিয়ে বাস্তুতন্ত্রে সাপের গুরুত্ব আমরা বুঝতে সক্ষম হয়েছি। তা হলেও সাপ এখনও আমাদের কী বন্ধু হয়ে উঠেছে? একটা বিভেদ রেখা বোধহয় রয়েই গেছে। পৃথিবীতে বিষধর আর নির্বিষ সাপের অনুপাত প্রায় ১:৯। অর্থাৎ বিষধর সাপের সংখ্যাই কম। নির্বিষ সাপের সংখ্যা তার নয় গুণ। কিন্তু তবুও মানুষের মন মানে না। মেঠোচারি, বৃক্ষচারী, গর্তবাসী, সামুদ্রিক সাপ নির্বিষ হোক বা বিষধর — আমাদের আতঙ্কের আবহে ক্রমাগত নিধন হয়ে যায়। তবে আশার কথা, জনজাতি বহু সমাজের টোটেম ও ট্যাবু সাপের পক্ষে, তাই কিছুটা লোকসংস্কৃতিগতভাবে রক্ষাও পেয়েছে সাপ।
বাংলার লোকমানসে সর্পভীতি থেকেই মনসামঙ্গল কাব্যের উৎপত্তি। চতুর্দশ শতাব্দীর কবি কানা হরিদত্ত রচিত ‘পদ্মার সর্পসজ্জা’ থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের কবি বিষ্ণুপালের ‘অষ্টমঙ্গলা’, ষষ্ঠীবর দত্তের পদ্মাপুরাণে তার প্রকাশ। পঞ্চদশ শতকের কবি বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণ’-এও আমরা সর্প প্রজাতির নানান বৈচিত্র্য লক্ষ্য করি। এখানে দেবী মনসা নাগ-আভরণে সজ্জিত হয়ে ধর্মরাজ যমের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছেন —
“সিন্দুরিয়া নাগে পরে শিরেত সিন্দূর।
নাগরাজ দিয়া বান্ধে মাথার মঞ্জর।।
কাজলিয়া নাগে দেবী পরিল কাজল।
কর্ণফুল নাগে দেবী পরে কর্ণফুল।।
বরারিয়া নাগে পরে গলার পাটাগুলি।
পঙ্গরাজ নাগে পরে পায়েত পাশুলি।।
সঙ্খিনী নাগে দেবী হাতে পরে শাঁখা।
গাম্ভুর গম্ভীর নাগে ধ্বজের পতাকা।।
বড় বড় নাগ সব চারি পাশে বেরি।
উদয়কাল মহাকাল রথের চাকা বরি।।”
কাব্যের অন্যত্রও সর্পবৈচিত্র্যের কথা আছে, যে সমস্ত সাপের আগমনে দেবতারাও ভয় পেয়ে যান —
“আইরাজ নাগ/ আইল নাগ মঞ্জরি।
সিংহমুখ নাগ/ আইল বরহি প্রচরি।।
উরসা সাপিনী/ আইল পদ্মার বোনঝি।
শত যোজন মুখখান/ ষাইট যোজন জি।
কলি পর্বত হইতে/ আইল মহাকালী।
শত শত হস্তী তার/ ভোজন বিকালি।।
পদ্মার আদেশে নাগ/ আসিল উর্ধমুখে।
দেবগণ শুনিয়া/ ভয় পায় বুকে।।”
কানা হরিদত্তের মনসামঙ্গল কাব্যের ভণিতায় ‘সর্পসজ্জা’ ছত্রে দেবী মনসার বিবরণ সর্পবৈচিত্র্যের পরিচয়বাহী —
“দুই হাতের সঙ্খ (শঙ্খ) হইল গরল সঙ্খিনী।
কেশের জাত কৈল এ কালনাগিনী।।
সুতলিয়া নাগ কৈল গলার সুতলি।
দেবী বিচিত্র নাগে কৈল হৃদয়ে কাঁচুলি।।
সিন্দুরিয়া নাগে কৈল সিতের সিন্দুর।
কাজুলিয়া কৈল দেবীর কাজল প্রচুর।”
সাপ এক ভয়ঙ্কর-সুন্দর প্রাণী। লোককবি সাপের সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছিলেন বলেই মঙ্গল কাব্যে দেখা যায় দেবী নানান সাপে সজ্জিতা — কোনো সাপ তার গলার হার, কোনো সাপ কাঁচুলি, কোনোটি হাতের বালা। এই নান্দনিকতা বিশ্বসাহিত্যে বিরল।
অন্নদামঙ্গল কাব্যেও দেখা যায় কৃষিবাস্তুতন্ত্রে সর্পবৈচিত্র্যের কথা, “কেউটে খরিশ কালী গোখুরা ময়াল।
বোড়া চিতি শঙ্খচূড় সূঁচে ব্রহ্মজাল।।
শাঁখিনী চামর কোষা সূতার সঞ্চার।
খড়ীচোঁচ অজগর বিষের ভান্ডার।।
তক্ষক উদয়কাল ডারাশ কানাড়া।
লাউডগা কাউশর কুয়ে বেতাছাড়া।।
ছাতাড়ে শীয়রচাঁদা নানাজাতি বোড়া।
ঢেমনা মোটিলী পুঁয়ে হেলে চিতী ঢোঁড়া।।
বিছা বিছুপিঁপিড়া প্রভৃতি বিষধর।সৃষ্টিহেতু জোড়ে জোড়ে গড়িল বিস্তর।।”
এখানে কোবরা গ্রুপের কেউটে (Indian Cobra), খরিশ/গোখরো (Common Cobra), শঙ্খচূড় (King Cobra) সাপের মত বিষধর সাপের নাম পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া বিষধর শাঁখিনী (Banded Krait), শীয়রচাঁদা (কালো কালাচ Black Krait), বোড়া (চন্দ্র বোড়া Russell’s Viper)-র মত তীব্র বিষধর সাপের কথা আছে। এ সকলই বাঙ্গলার সর্প বৈচিত্র্য। এছাড়া নাম পাওয়া যাচ্ছে নির্বিষ এবং স্বল্প বিষধর কয়েকটি প্রজাতির সাপ, যেমন ময়াল (Rock Python), অজগর (Common Python), বোড়া চিতি (Wolf Snake), দাঁড়াশ (Rat Snake), কানাড়া বা কাঁড় (Common Cat Snake), লাউডগা (Whip/Vine Snake), বেতাছাড়া (Bronze Back Snake), মেটিলি, পুয়ে (Common Blind Snake), হেলে (Stipped Keelback), ঢোঁড়া (Checkered Keelback) ইত্যাদি।
সাপ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র লভ্য, লভ্য কৃষিবাস্তুতন্ত্রেও। বাংলার জমি-জিরেতে, জলে-জঙ্গলে সাপের অহরহ আনাগোনা ছিল; ছিল সর্পাঘাতে মৃত্যুর ঘটনাও। ভয়ে-ভক্তিতে মানুষ সাপকে পুজো করতে শুরু করলো। তারই ধারাবাহিকতায় শুরু হল সর্প-চারণা বা স্নেক-লোর। দেবী মনসা হলেন বাঙ্গালি হিন্দুর সর্প-চারণার এক চরম আধ্যাত্মিকতা, নান্দনিক দার্শনিকতা।
ভারতীয় ডাকবিভাগ ২০০৩ সালে চারটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল সাপের ছবি দিয়ে। কৃষি-বাস্তুতন্ত্রে এই সাপগুলি ভারতের কোনো না কোনো অঞ্চলে পাওয়া যায়। এই চারটি সাপ হল বিষধর King Cobra বা শঙ্খচূড়, বিষধর Bamboo Pit Viper বা বাঁশ-বোড়া, ক্ষীণ-বিষ Gliding Sanke বা কালনাগিনী এবং নির্বিষ অথচ ভয়ঙ্কর Python বা অজগর।
জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে সর্প প্রজাতির সংখ্যা প্রায় শ’ খানেক। আমাদের দেশে সর্প বৈচিত্র্য আনুমানিক পৌনে তিনশো। এই যে বৈচিত্র্য, তার মধ্যে বিষের পরিমাণ বা বিষহীনতার যেমন তফাৎ, তেমনই তার দৈঘ্য-প্রস্থেও ফারাক। আমাদের দেশে সবচেয়ে ছোটো সাপের নাম ‘পুঁয়ে’, আর সবচেয়ে বড় সাপটি হল ‘জালি অজগর’ বা রেটিকুলেটেড পাইথন। পুঁয়ে সাপ ১০ সেন্টিমিটার, পাইথন সেখানে ১০ মিটার লম্বা। ভারতে বিষধর সাপের সংখ্যা পঞ্চাশের কিছু বেশি, এর অধিকাংশই সামুদ্রিক সাপ। ভারতের বিষধর সাপগুলি Elapidae (যেমন কেউটে, খরিশ, শঙ্খচূড়, শাঁখামুটি, কালাচ), Viperidae (চন্দ্রবোড়া, পাহাড়ি বোড়া, গেছো বোড়া, বুঁটি বোড়া, সবুজ বোড়া), Hydrophidae (সামুদ্রিক খড়গনাসা, কালশির, অঙ্গুরী ইত্যাদি) এবং Colubridae পরিবারের অন্তর্গত। ভারতে যে সমস্ত সাপ থেকে মৃত্যু অধিক হয়, তা হচ্ছে কালাচ, চন্দ্রবোড়া, কেউটে এবং গোখরো। কেউটে এবং গোখরো ফণাধর সাপ; কালাচ এবং চন্দ্রবোড়া ফণাহীন; চন্দ্রবোড়া হিমাটোটক্সিক সাপ যার দংশনে রক্তকণিকা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং রক্ততঞ্চনে গণ্ডগোল হয়। খুবই বিষাক্ত সাপ কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়, যা প্রবল বৃষ্টিপাতযুক্ত স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকে এবং বাসা বানায়।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি জলবায়ুর বৈচিত্র্যের কারণে সাপের বৈচিত্র্যও যথেষ্ট। এ রাজ্যে ছয়টি কৃষি জলবায়ুযুক্ত অঞ্চল আছে। পাহাড়ি অঞ্চল, তরাই অঞ্চল, গাঙ্গেয় নবগঠিত ও পুরাতন পলিমাটি গঠিত অঞ্চল, লাল ও কাঁকুড়ে মাটি অঞ্চল এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনামাটি অঞ্চল। প্রতিটি অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ কয়েকটি সাধারণ সাপের দেখা পাবার সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্যের সাপের মুখোমুখি হয়। আর এ রাজ্যের প্রাকৃতিক-ভৌগোলিক বৈচিত্র্য তো কম নয়! কোথাও বনভূমি, কোথাও বিস্তৃত বাগিচা, কোথাও চা বাগান, কোথাও স্বল্প সময়ের জন্য ফসল উৎপাদনের কৃষিক্ষেত্র, কোথাও বাদাবন, কোথাও সমাজভিত্তিক বন। কোথাও ডোবা, খানাখন্দ, এঁদো পুকুর, খাল-বিল-নদী-নালা, কোথাও মোহনা এবং সমুদ্র। যত বৈচিত্র্য, ততই সাপের রকমফের। পশ্চিমবঙ্গ সর্পবৈচিত্র্যের এক আদর্শ ঠিকানা। একশোটির মতো সাপের প্রজাতি রাজ্যে আছে, তাদের সংখ্যাও একসময় মন্দ ছিল না৷ মঙ্গলকাব্য লেখা হয়েছে তো বাংলার মানুষের সর্প ভীতি থেকেই।
বাস্তুতন্ত্রে সাপ গুরুত্বপূর্ণ প্রাণি। খাদ্য-খাদক সম্পর্কে খাদ্যশৃঙ্খলে সাপের উল্লেখযোগ্য অবস্থান। খাদ্যশৃঙ্খলে সাপ শিকারির ভূমিকা পালন করে। ফসল যেমন রয়েছে, ফসলের শত্রুপোকা আছে, আছে ইঁদুর-বাদুড়, ফসলখেকো, মাছখেকো পাখি। আর রয়েছে তাদের সকলের চিরশত্রু সাপ৷ খাদ্য-খাদক সম্পর্কের জালে জড়িয়ে আছে এরা সকলে। কোনো সাপ থাকে ইঁদুরের গর্তে, কেউ উঁইয়ের ঢিপিতে। ইঁদুরের গর্ত সাপের প্রিয় শিকারের জায়গা। ফসল পাকার পর ইঁদুর যত না খায়, তারচেয়ে বেশি খাবার কেটে সংগ্রহ করে রাখে গর্তে। ইঁদুরের গর্তে থাকে অজস্র ছানাপোনা, তাই শিকারের পক্ষে ভাল জায়গা। গর্তে শিকার ধরতে আসে বালিবোড়া (Red Sand Boa), তুতুর (Common Boa), দাঁড়াশ (Indian Rat Snake), খেতমেটে, শাঁখামুটি (Banded Racer), কালাচ (Common Krait) প্রভৃতি।
উঁইয়ের ঢিপিতে সাপের বসবাস এবং উঁইপোকা খাওয়ার ঘটনা দেখতে পাওয়া যায় দুধরাজ (Common Trinket Snake), দাঁড়াশ, উদয়কাল, শাঁখামুটি, কালাচের ক্ষেত্রে। বেত আছড়া, কঙ্করাজ, ঘরচিতি সাপ খড়ের গাদায় শিকারের সন্ধানে আসে। উত্তরবঙ্গের ঘাসজমি যেখানে মাঝারি, ঝোপঝাড় লুকোনোর সুবিধা আছে, সেখানে শিকারের সন্ধানে দেখা মেলে ময়াল (Indian Rock Python), অজগর (Python) সাপ। বালিয়াড়ির ঘাসজমিতে পাওয়া যায় বালিবোড়া। রাজ্যের নীচু ঝোপঝাড়ের ঘাসজমিতে পাওয়া যায় সবুজ ঢোড়া (Green Keelback), লাউডগা (Vine Snake), ভাড় (Mock viper) সাপ। বৃক্ষবাসী সাপের মধ্যে কালনাগিনী (Ornate Flying Snake), বেত আছড়া (Common Bronzeback Tree Snake), সবুজ বেত আছড়া (Green Bronzeback Tree Snake), রংবাহার (Painted Brownback Tree Snake), বাদামী দাঁড়াশ (Indo-Chinese Rat Snake), বু্ঁটি বোড়া (Spot tailed Pit Viper), সবুজ বোড়া (White Lipped Pit Viper) প্রভৃতি সাপের আনাগোনা দেখতে পাওয়া যায়।
সাপের ভূমিকা সত্ত্বেও, সাপের বিনাশ ঘটছে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষিবিষের অপব্যবহারের প্রাবল্যে। অনিচ্ছাকৃত নন-টার্গেট টক্সিসিটির কারণে সাপ মারা পড়ে কৃষি বাস্তুতন্ত্রের নানান স্থানে নিত্যদিন। প্রাকৃতিক ভারসাম্যের এ একটি অনভিপ্রেত ঘটনা।
তথ্যসূত্র:
১. কৃষি বাস্তুতন্ত্রে সাপ, সর্পদংশন ও তার প্রতিকার — ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং ডা. অমিত ভট্টাচার্য, ২০১৬ পঞ্চায়েতী রাজ, ৯(১১) নভেম্বর: পৃষ্ঠা ২০-৩০
২. বাংলার জৈববৈচিত্র্য ও লোকসংস্কৃতি — ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০২৪ (তৃতীয় সংস্করণ) কবিতিকা, মেদিনীপুর, পৃষ্ঠা ১৪৯-১৫৭
৩. Snakes in Bengal: বাংলায় সর্পবৈচিত্র্য ও সর্পদেবী মনসা, Kolkata News Today, July 16, 2023.
বাণীব্রত রায় এবং কল্যাণ চক্রবর্তী