ছোট্ট একটি প্রদীপের আলো এক এক হাত থেকে আর এক হাতে যেতে যেতে একটি একটি করে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আর ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে একটি আলোর বলয়। ছবিটা এরকমই।
স্থান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাবড়া ১নং ব্লকের মাকালতলা গ্রাম। বস্তুত মাকালতলা এবং সংলগ্ন ফার্মানিয়ার আদিবাসী পাড়ায় সেবা (সোসাইটি ফর ইকুইটেবল ভলান্টারি অ্যাকমনস) এই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চাষের কাজে প্রশিক্ষণ দানে যুক্ত সরকারি সংস্থা ‘ক্রাইজাফ’-এর সহযোগিতায়।
নানাবিধ প্রশিক্ষণ, মূলত জৈব চাষ, শিক্ষার বিস্তার, আদিবাসী উন্নয়ন ইত্যাদি কাজে উত্তর চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া, হাবড়া ১, হাবড়া ২, দেগঙ্গা, স্বরূপনগর, মিনাখাঁ, বনগাঁ রুরাল, বরাহনগর ব্লকে সেবা নিঃশব্দে সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবর্তনের কাজ করে চলেছে দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে।
আইআরআরআই (ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইন্সটিট্যুট) – এর উদ্যোগে মাকালতলায় সবে শুরু হয়েছে এক ‘থিওরি অফ চেঞ্জ’ এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সাথে সাথে চাষের নতুন পন্থার হাত ধরে নারী কৃষকদের সক্ষমতা বাড়ানো, সচেতনতা তৈরি করা, তাঁদের অস্তিত্ব, অধিকার, দায়িত্ব সম্পর্কে চেতনা জাগানো এই উদ্যোগের সারমর্ম। ছাগল পালন এখানে সক্ষমতা বাড়ানোর প্রবেশপথ এবং নারী কৃষকদের সঙ্গে যোগসূত্রের প্রথম ধাপ।
সেই সূত্র ধরে ক্রমে ক্রমে বিকশিত হচ্ছে নারীদের মানবিক চেতনা। প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবেশ সচেতনতার হাত ধরে নারীরা গুটি গুটি করে এগোচ্ছেন নিজের ভূমিকা সম্পর্কে ভাবনায়, স্বনিযুক্তির পরিকল্পনায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পারদর্শিতা আর নিজের ইচ্ছে প্রকাশের মনোবল অর্জনের দিকে।
আজ সারা রাজ্য স্বাক্ষর, কিন্তু সেই স্বাক্ষর ছবি আঁকার মতো। মাকালতলায় স্বাক্ষরতার ক্লাস শুরু করেছে সেবা। খুব ধীর হলেও অগ্রগতি হচ্ছে শিক্ষা কেন্দ্রের। আইআরআরআই-এর ডক্টর প্রমা মুখোপাধ্যায় মুঠোফোনে রেকর্ড করতে শিখিয়ে মেয়েদের কাছে নতুন একটা দিক খুলে দিয়েছেন। সেবা’র অভীক মিত্র এবং কুতুবউদ্দিন আহমেদ অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলছেন কৃষক দলগুলি।
১৬ জন নেত্রী, ৬টি দল, ১৭৫ জন নারী কৃষক। সামনে রয়েছেন লক্ষ্মী সর্দার সঙ্গে দুলাল, অরুণ, দিপালী, অপর্ণা আর সব লিড ফার্মাররা। আইভিআরআই ছাগল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দেড় শতাধিক নারী কৃষককে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং ১৬ জন নেত্রীকে শেখাবেন ছাগলের প্রতিষেধক ও প্রাথমিক চিকিৎসা।
এই ‘থিওরি অফ চেঞ্জ’- এর প্রয়োগে অংশীদার আইভিআরআই, ‘প্রদান’, উত্তর চব্বিশ পরগনায় ‘সেবা’, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় ‘চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ’। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ১৬ জন লিড ফার্মারকে দেওয়া হয়েছে খাতা আর পেন, যাতে তাঁরা নিজেদের ভাবনা, প্রজেক্টের কাজের মূল্যায়ন, কাজের প্রতিফলনের টুকিটাকি লিখে রাখেন আর হয়ে ওঠেন গবেষণার মূল্যবান অংশীদার। নিজেরাই স্থির করেছেন যিনি এখনও লিখতে পারেন না তাঁকে বাকিরা সাহায্য করবেন লিখে ফেলার কাজে। এই খাতাগুলি যেন এক একটি দর্পণ।
https://googleads.g.doubleclick.net/pagead/ads?client=ca-pub-8743107112916400&output=html&h=90&adk=4003599297&adf=2763425741&pi=t.aa~a.3751990625~i.15~rp.4&w=773&abgtt=btvi=5&fsb=1&dtd=786
দিপালী লিখেছেন- আমরা আদিবাসী, তুই বলতে আপনি বলি আর আপনি বলতে তুই, তাই সবার সামনে কথা বলতে লজ্জা করে, অপর্ণা লেখাপড়া শেখাবার দায়িত্ব পেয়ে আপ্লুত, কেউ কম্বল বিছাচ্ছেন ছাগলের যত্ন করতে, কেউ আনন্দিত ছাগলের স্বাস্থ্য ভাল হওয়ায়।
আইআরআরআই-এর উদ্যোগে বিচালি কাটার মেশিন বসবে শিগগিরই। মেয়েদের পরিকল্পনা সবাই মিলে বিচালি কাটার মেশিনে বিচালি কেটে নিজেরা ছাগলের জন্য ব্যবহার করবেন, আবার প্যাকেট করে বিক্রিও করবেন। সৌর লণ্ঠন আসবে যাতে সন্ধের অবসরে লেখাপড়া করা যায়।
কতটুকু ভালো হবে সেকথা বিচারের সময় এখনও আসেনি। কিন্তু বদল যে হচ্ছে সে কথা স্পষ্ট। মেয়েদের স্বপ্ন বিচালি কাটার মেশিনের পর মুড়ি ভাজার যন্ত্র, মশলা ভাঙাবার যন্ত্র বসিয়ে সবাই মিলে হাত মেলাবেন স্বনিযুক্তিতে। তাঁরা চিরকাল গ্রামে আসা পাইকারকেই ছাগল বিক্রি করেছেন, কিন্তু এইবারে তাঁরা শিখেছেন ছাগল হাতের মাপে নয়, উচ্চতার মাপেও নয়, বিক্রি করতে হয় ওজন যন্ত্রে মেপে।
পরিবর্তনের ছোঁয়ায় স্বপ্ন দেখছেন সকলেই।আইভিআরআই -এর ডঃ মহেশ, ডঃ অর্ণব সেন ভাবছেন কোনও এক সময় মাকালতলা ব্রান্ড নামে গোট মিট প্রসেসড বা প্যাকড ফুড হিসেবে বিক্রি হবে। ডঃ দাস চান গ্রামের পশুদের চিকিৎসা করবেন লিড ফার্মাররা। আইআরআরআই-এর টিম চায় বিকাশের বার্তা লিড ফার্মারদের মাধ্যমে ছড়িয়ে যাক দলের মহিলাদের কাছে, অন্তর্ভুক্ত হোন পরিবারের পুরুষরাও। ‘সেবা’ মহিলাদের স্বপ্নের শরিক, মহিলাপ্রধান এফপিসি গঠনের ভাবনা তাঁদের।
খুব শিগগিরই জমজমাট করে শুরু হবে লেখাপড়া মহিলা পুরুষ সকলের জন্য। ব্যাংকে টাকা তোলা বা জমা করার আবেদনপত্রটা যেন পূরণ করতে পারেন নিজেরা। লেখাপড়া করতে গিয়ে বোঝা যাচ্ছে অনেকেরই চোখের সমস্যা। ‘সেবা’ থেকে চিকিৎসা শিবির করা হবে অতি দ্রুত। বাজ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা এখন ঘটছে প্রায়ই। এ বিষয়ে সচেতনার মিটিং করে স্থানীয় উপকরণেই তৈরী করে বসানো হবে লাইটনিং ক্যাচার।
লিঙ্গের ভিত্তিতে বৈষম্যকে সরাবার প্রচেষ্টা থাকবে প্রতিটি ধাপেই। মুঠোফোন থাকবে লিড ফার্মারদের কাছে, তাঁরা আসন্ন দুর্যোগ, পশুরোগ বা শস্যের মহামারী, উন্নত কৃষির পরামর্শের খবর রাখবেন এবং নিয়মিত তা পৌঁছে দেবেন দলের সদস্যদের কাছে।
খুব সম্প্রতি প্রচণ্ড গরমে ছাগলেরা জ্বর, পেটের সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, লক্ষ্মী, অপর্ণারা নিজেরাই আইভিআরআই এর ডাক্তারবাবুকে ফোন করে নির্দেশ নিয়ে সেগুলোকে সারিয়ে তুলেছেন। তাঁরা অভীক, কুতুবউদ্দিন, ডঃ বিশ্বাসের সঙ্গে কাজ শিখতে যাচ্ছেন কল্যাণীতে আইভিআরআই-এর খামারে।
এর পরে যাবেন প্রদানের সংগঠিত খামার দেখতে পুরুলিয়ার আদিবাসী অঞ্চলে। নিজেদের শক্তিকে তাঁরা চিনতে শুরু করেছেন। নিজেদের সেই নিজেকে খুঁজে পেতে আরও ছোট ছোট ভাবনা রয়েছে ‘সেবা’-র, সরকারি প্রকল্প, আইনী অধিকার সম্পর্কে ক্লাস, মুভি দেখা, ডিএমটি সেশন, পুষ্টিকর সহজ রান্না- সেগুলি স্থিরিকৃত হবে আইআরআরআই-র সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে।
এরপর পরিকল্পনায় রয়েছে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি গুলির মাধ্যমে মহিলারা নিজেদের জোরে তৈরি করবেন নিজেদের সমবায় এবং লিঙ্গ বৈষম্য-জনিত পরিবেশ পরিবর্তন করে পুরুষ এবং নারী একযোগে তৈরি করবে এক আদর্শ পরিবেশ যেখানে সকলেই বাঁচবেন সসম্মানে।