লেনদেনের ক্ষেত্রে একসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিময় বস্তু ছিল “কড়ি।” এই প্রাকৃতিক বস্তুটি প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখনও আমরা টাকার সঙ্গে “কড়ি” জুড়ে “টাকাকড়ি” বলে থাকি।
প্রাচীন ভারতের কড়ির উৎস সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। তবে মধ্য যুগের শেষদিকে ভারতে কড়ি আসতো মালদ্বীপ থেকে, তার তথ্য রয়েছে। মালদ্বীপে ৪০ বা ৪২ পণ কড়ি অর্থাৎ ৩২০০ থেকে ৩৩৬০ টি কড়ির দাম ছিল ৬ থেকে ৭ আনা, যা আজকের মূল্যে ৩৫ থেকে ৪০ পয়সা। মালদ্বীপ থেকে এই কড়িগুলি আসতো পশ্চিম ভারতের সুরত বন্দরে এবং সেখানে এগুলি বিক্রি হতো ৪ টাকা হন্দরে। ব্যবসায়ীরা মালদ্বীপ থেকে টাকায় ৯ থেকে ১০ হাজার কড়ি কিনে বাংলাদেশের বাজারে সেগুলি বিক্রি করতো টাকায় ২৫০০ থেকে ৩২০০ হিসেবে।
ব্রিটিশ ভারতের কোনো কোনো জায়গায় কড়ি দিয়ে খাজনা নেওয়া হতো। যেমন, খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তাদের শ্রীহট্ট জেলার ধার্য আড়াই লক্ষ টাকা খাজনার প্রায় সবটাই নিতো টাকায় ৫১২০ কড়িতে। এরপর এই সাড়ে আঠাশ কোটি কড়ি শ্রীহট্ট থেকে ঢাকায় আনা হতো।
বাংলায় মৌর্যযুগে কড়ির প্রচলন ছিল। মহাস্থানগড় অভিলেখে উল্লিখিত “গণ্ডক” কথাটি তার প্রমাণ। গুপ্তযুগে ভারতে আসেন চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন। তিনি তখন বাজারে শুধু কড়িই দেখেছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে খ্রিস্টিয় সপ্তম শতাব্দীতে আসা আরেক চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারতের বাজারে কড়ির পাশাপাশি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা এবং মূল্যবান পাথরের সাহায্যে ভারতের বাজারে কেনাবেচা হতো বলে জানিয়েছেন।
এর দুশো বছর পর পূর্ব ভারতের পাল সাম্রাজ্যে সোণা-রূপোর পাশাপাশি কড়ি দিয়ে বাজারে কেনাবেচা চলতো বলে জানিয়েছেন আরব বণিক সুলেমান। খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন তাঁর “তবকৎ-ই-নাসিরী”-তে গৌড়-বঙ্গের সেনরাজ লক্ষ্মণসেন সম্পর্কে বলছেন, তিনি এক লক্ষ কড়ির কমে কাউকে দান করতেন না। এছাড়া সেন বংশের তাম্রশাসনে দেখা যাচ্ছে, ভূমির বার্ষিক আয় নির্ধারিত হচ্ছে “কপর্দক পুরাণ” হিসেবে, যার অর্থ—কড়িতে গোনা পুরাণ।”কপর্দক পুরাণ” মানে—রূপোর তৈরি কার্ষাপণ বা কাহন। একসময় রূপোর মুদ্রায় ভূমি রাজস্ব নির্ধারিত ছিল, কিন্তু যখন পূর্ব ভারতে রূপোর মুদ্রার ( যার ওজন ছিল প্রায় ২০ রতি) ঘাটতি দেখা দেয়, তখন তার অনুপাতে বাংলা-বিহারে কড়ি ব্যবহৃত হতো। নেপালে প্রচলিত ছিল “পণ-পুরাণ” এবং সেখানে তামার মুদ্রা ব্যবহৃত হতো।
সুতরাং, সেন আমলেও কড়ির প্রচলন ছিল।
আদি-মধ্যযুগে কাশ্মীরেও ছিল কড়ির প্রচলন এবং সেখানে কড়িকে বলা হতো “দিন্নার”, যা “দিনার” শব্দের অপভ্রংশ। খ্রিস্টিয় অষ্টম শতাব্দীতে সেখানকার রাজা জয়াপীড়ের সভাকবি উদ্ভট ভট্টের দৈনিক বেতন ছিল এক লক্ষ দিন্নার। আবার খ্রিস্টিয় নবম শতাব্দীতে রাজা শঙ্করবর্মা জনৈক ভারবাহককে দৈনিক বেতন দিতেন দুই হাজার দিন্নার। সে সময় কাশ্মীরে এক “খারী” ( প্রায় ৯০ সের বা ৮৪ কিলোগ্রাম) ধানের স্বাভাবিক মূল্য ছিল দুশো দিন্নার। এছাড়া খ্রিস্টিয় একাদশ শতাব্দীতে সেখানকার রাজা অনন্ত শাহী তাঁর দুই রাজপুত্র রুদ্রপাল ও দিদ্দাপালকে যথাক্রমে দৈনিক দেড় লক্ষ এবং আশি হাজার দিন্নার বেতন দিতেন। কথিত আছে, তিনি তাঁর একজন ভৃত্যকে দান করেছিলেন ৯৬ কোটি দিন্নার। সে সময় রাজকোষে হাঁড়ি ভর্তি করে কড়ি রাখা থাকতো।
কাশ্মীরী লেখক কলহনের “রাজতরঙ্গিণী” গ্রন্থেও খ্রিস্টিয় একাদশ শতাব্দীর শেষভাগ সময়ের রাজা কলশের আমলে দিন্নার অর্থাৎ কড়ির উল্লেখ আছে।
বাণিজ্যিক লেনদেনে কড়ি উঠে গেলেও কড়ি রয়ে গেছে আমাদের ঘরের লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে। বীরভূম জেলার নিত্যানন্দ জন্মস্থান ময়ূরেশ্বরের একচক্রা গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে “ঘোষগ্রাম।” এখানে রয়েছেন কাঠের তৈরি মা লক্ষ্মী। প্রতি বছর এখানে প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে বসে কড়ির মেলা। এছাড়াও বীরভূমের সদর শহর সিউড়ি লাগোয়া গ্রাম “কড়িধ্যা”, যে নামটি এসেছে “কড়ি ডিহি” থেকে বলে গবেষকদের অভিমত। সুতরাং, কড়ি রয়েছে আমাদের সংস্কৃতিতে, আমাদের ঐতিহ্যে।
তথ্যসূত্র:
1). Media of Exchange in Ancient India, Journal of Ancient Indian History, Vol.X, 1976-77: D.C. Sirkar.
2) ব্যক্তিগত ক্ষেত্র সমীক্ষা।