ছত্রপতি কে? সাধারণ জ্ঞানে যিনি ছাতা ধরে থাকেন। কিন্তু ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অনেক গভীর, তাৎপর্যপূর্ণ। গৃঢ় অর্থে ছত্রপতি তিনি যাঁর ছত্রছায়ায় সবাই নিরুপদ্রবে, নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্তে অবস্থান করে। যার অভয়মুদ্রা ছাতার মতো সবার মাথা আগলে রাখে। ছত্রপতি তিনি যাঁর আশ্বাস মানে প্রশ্নাতীত বিশ্বাস, যাঁর ছায়া মানে পরম নির্ভরতা। যাঁর ছত্রতল বিচ্যুত হওয়া মানে অধর্মে পতিত হওয়া, দুর্গতির রসাতলে তলিয়ে যাওয়া। অধর্মকে আশ্রয় করা, বিনাশকে আলিঙ্গন করা। মহাভারতে এরকম পুরুষ হলেন মহাবৃষ্ণি বাসুদেব। ভূ-ভারতে মহাতেজ, মহাশক্তি, মহাপরাক্রম এবং মহামেধায় যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ। মহাভারত’ নামে এক মহাকাব্যের আঙ্গিকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসদেব ভারত নামের এক রাষ্ট্রীয় ধারণা (concept) দিয়ে। গেছেন। কৃষ্ণচরিত্র অনুসরণ করলে বুঝতে পারা যায় সেই রাষ্ট্রচেতনার আদি রূপকার তিনিই। রাষ্ট্র যদি জাতিসত্তার (nation) দ্যোতক হয় তবে মহাভারতে কৃষ্ণই রাষ্ট্র। মহাকাব্যের মোড়কে মহাভারত এমন এক ছায়াছত্র, কুরুক্ষেত্র মহাসমরের অনিবার্য মন্থনে যে ছত্রতলে এসে মেশে অসংখ্য খণ্ডরাজ্য। ঐহিক দৃষ্টিতে সেই বৃহৎ ছত্র পাণ্ডবেরা। কিন্তু পারমার্থিক দৃষ্টিতে তার ভরকেন্দ্র শ্রীকৃষ্ণ। গূঢ় অর্থে তিনিই রাষ্ট্র, তিনিই মহাভারত। ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছিল এমন ধারণা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। কিন্তু এই মহাযুদ্ধ এবংতার আগে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ যে এক অখণ্ড রাষ্ট্রচেতনার রূপ পরিগ্রহ করেছিল, তার মূলকেন্দ্র যে কৃষ্ণ এবং তিনিই যে সর্বকালের সর্বোত্তম পুরুষ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ব্যাপারে কৃষ্ণের নিজেরই আত্মবিশ্বাস কতখানি দৃঢ় ছিল তার প্রমাণ পাই শ্রীমদ্ভগবত গীতায়। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে তিনি অর্জুনকে বলছেন, “রাণাঞ্চনরাধিপম্ন রগণের মধ্যে আমিইনরাধিপ। এখানে আমিত্বের অহং অন্বেষণ করতে যাওয়া বৃথা। বারান্তরে এমন কথা তিনি আরও অনেকবার বলেছেন। অর্জুনকে নিজের বিশ্বরূপ পর্যন্ত দর্শন করিয়েছেন। এহেন কৃষ্ণ যে কেবল নর বা মানুষ ছিলেন এইটুকুই নয়। তিনি ছিলেন গোলোকাধীশ বিষ্ণুরনরাবতার। তাই তার মধ্যে মনুষ্য প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে ছিল অতীন্দ্রিয় ঐশ্বরিক গুণাবলীও। মর্ত্যধামে দুষ্কৃতী বিনাশ করে ন্যায় ও ধর্মের অনুসারীদের পরিত্রাণের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসার জন্যই অবতাররূপে তার আবির্ভাব ঘটেছিল। ধর্মভ্রষ্ট, দুরাচারীদের কবল থেকে ভারতভূমিকে কলুষমুক্ত করে ধর্ম তথা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে সুদর্শন চক্রের মতো অমোঘ অস্ত্রেরও যে প্রয়োজন হতে পারে তার মূর্ত বিগ্রহ ছিলেন তিনি। প্রজারঞ্জক রাজার (তৎকালীন সময়ের প্রথা) মধ্যে দিয়েই যে মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে, এরকম রাজারাই যে ভগবানের বিভূতিস্বরূপ, কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গনে পার্থসারথিরূপে উপস্থিত থেকে অর্জুনকে সেকথা ব্যাখ্যা করেছেন। আর এরকম রাজার রাজা ছিলেন তিনি নিজে।
কৃষ্ণের অনুমান শক্তি, সর্বজ্ঞতা ছিল তুলনাহীন। বারণাবতের জতুগৃহ থেকে গুপ্তপথে পালিয়ে মাতা কুন্তীসহ পাণ্ডবরা তপস্বীর বেশে। কীচক দেশের মধ্যে দিয়ে একচক্রা পৌঁছন। সেখানকার অধিপতি নরাধম বক-কে হত্যা করেন। তারপর সোমাশয়ণে গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণকে পরাজিত করে পৌঁছন পাঞ্চাল রাজ্যে, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভাস্থলে। কুন্তীকে আশ্রয় দিলেন এক কুম্ভকার। স্বয়ম্বরের লক্ষ্যভেদে পাঞ্চালীকে জয় করে পঞ্চপাণ্ডব যখন কুন্তীর কাছে নিয়ে এলেন। তখন বলরামকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে প্রায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেন কৃষ্ণ। যুধিষ্ঠির বিস্ময়াভিভূত হয়ে জানতে চাইলেন ছদ্মবেশী পাণ্ডবদের তিনি চিনলেন কীভাবে? কৃষ্ণ তার চিরপরিচিত স্মিত হাসিতে জবাব দিলেন, ‘আগুন ছাইচাপা থাকলেও তার তাপ ও তেজ অনুভব করা যায়। মহারথীদের মধ্যে থেকে পাঞ্চালীকে জয় করে নেবার সামর্থ্য আর কাদের থাকতে পারে?’আগুনেরশক্তি চেনার এই যে অতীন্দ্রিয় মেধা, ঈশ্বরাবতার পুরুষোত্তম কৃষ্ণ ব্যতিরেকে মনুষ্যকুলে বিরল। পাণ্ডবরা আগুন কিন্তু আপাতত তারা অজ্ঞাতবাসেই থাকুন, তাতে তাদের ভালোই হবে এই পরামর্শ দিয়ে কৃষ্ণ-বলরাম বিদায় নিলেন। ওই পরামর্শের মধ্যে দিয়ে কৃষ্ণ সেদিন ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন পাণ্ডবরা তা বুঝতে পারেননি। কিন্তু কৃষ্ণের বুদ্ধিমত্তার ওপর তাদের অগাধ ভরসা ছিল। তাদের মাথার ওপর বাসুদেবের ছত্রছায়া আছে এই আস্থায় দ্রৌপদী জয়ের বলবীর্যে বলিয়ান প্রমাণিত হয়েও পাণ্ডবরা তার পরামর্শ মাথা পেতে মেনে নিয়েছিলেন। সুফল পেলেন তার কিছুদিন পরেই। তপস্বীবেশী পঞ্চপুরুষ যে পঞ্চপাণ্ডব, স্বয়ম্বর ঘটনার পর থেকেই সর্বত্র কানাঘুষা চলছিল। তাদের শক্তি-সামর্থ্যের আলোচনা চলছিল মুখে মুখে। এর সুযোগ গ্রহণ করতে দেরি করলেন না কৃষ্ণ। তাঁর পরামর্শে পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরে উপস্থিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দৃপ্তভঙ্গিতে রাজত্বের দাবি করলেন। পাণ্ডবদের সেই দৃপ্ততার মুখে নরম হয়ে পিতামহ ভীষ্মকে সামনে রেখে কৌরবপতিতাঁদের অর্ধেক রাজত্ব দিতে রাজি হলেন। তবে এমন জায়গা ছাড়লেন যা সভ্য মানুষের বসবাসের অযোগ্য। সেটা হলো খাণ্ডবপ্রস্থ। এলাকাটা জঙ্গলাকীর্ণ এবং সর্প ও দানব সঙ্কুল। এবারও পাণ্ডবদের মাথায় অভয়ছত্র ধরে কৃষ্ণ বললেন, চিন্তা করো না, হতাশ হয়ো না। অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে সেই বন দহন করে জনপদ গড়ে তোলার উপযুক্ত করে দিলেন। কৃষ্ণের কথামতো স্থাপত্যবিদ ময়নির্মাণ করে দিলেন এক সুরম্য ও অতুলনীয় নগর-রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ। যার রাজপ্রাসাদে খচিত হলো মৈনাক পর্বত থেকে নিয়ে আসা মণিরত্ন।
জ্যেষ্ঠপাণ্ডব যুধিষ্ঠির সিংহাসনারূঢ় হওয়ার কিছুদিন পরেই দেবর্ষি নারদ এসে তাঁকে রাজসূয় যজ্ঞ করে শ্রেষ্ঠ নৃপতির শিরোপা লাভ করতে বললেন। সেইসঙ্গে রাজধর্ম সম্পর্কে দিয়ে গেলেন নানামূল্যবান উপদেশ। কালক্ষেপনা করে কৃষ্ণকে দ্বারকা থেকে ইন্দ্রপ্রস্থে আনানো হলো।নারদের পরামর্শ নিয়ে কী করা যায় তা নিয়ে হলো মন্ত্রণা। কৃষ্ণ বললেন, এমনিতে সব ঠিক আছে কিন্তু সমস্যা জরাসন্ধকেনিয়ে। মগধের দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা এখনো বর্তমান। তার ভয়ে সবাই তটস্থ। ভগদত্ত, সুর, মেঘবাহন, করভ, বক্র প্রমুখ প্রায় সব রাজাই তার অনুগত। বঙ্গ-পু-কিরাতের রাজা পৌণ্ড্রক এবং ভোজরাজা ভীষ্মক-এর মতো শক্তিশালী রাজারা পর্যন্ত জরাসন্ধকে শ্রেষ্ঠ ও সম্রাট বলে মানেন। আমাদের পক্ষে বস্তুত পশ্চিম এবং দক্ষিণ দেশের রাজা পুরুজিৎ ছাড়া কেউ নেই। এখানে কৃষ্ণের রাজনীতি তথা কূটনৈতিক প্রজ্ঞার একটা দিক আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়ে যায়। বেশ কিছু বছর আগে মথুরার অধিপতি দুরাচারী কংসকে তার রাজসভার মধ্যেই নিধন করেছিলেন কৃষ্ণ। শূরসেন সাম্রাজ্যের অধিপতি কংস ছিলেন যাদব, অন্ধক, বৃষ্টি এবং ভোজদেরও রাজা। তাঁকে হত্যা করে তার সিংহাসনে কংসের পিতা উগ্রসেনকে উপবেশন করালেও এইসব রাজা প্রকৃতপক্ষে চলে এসেছিল কৃষ্ণেরই নিয়ন্ত্রণে। উগ্রসেন ছিলেন নিমিত্তমাত্র।
কংস ছিলেন জরাসন্ধের জামাই। তার দুই স্ত্রী অস্তি ও প্রাপ্তির পিতা জরাসন্ধ জামাতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে অনবরতমথুরায় আক্রমণ শানিয়ে যেতে থাকেন। তবে প্রত্যেকবারই কৃষ্ণ-বলরামের কাছে প্রতিহত হতে হয়। টানা সতেরোবার জরাসন্ধের আক্রমণ প্রতিহত করার পর কৃষ্ণ বুঝলেন এভাবে যাদবদের মথুরায় শান্তিতে বসবাস করা সম্ভব হবে না। তাই আঠারোবারের আক্রমণের আগে দ্বারকারসমুদ্রে এক দ্বীপখণ্ডে নগর পত্তন করে মথুরা থেকে যাদবদের সেখানে নিয়ে চলে যান। কিন্তু মগধরাজের ওই প্রতিহিংসাপরায়ণতা এবং বারংবার মথুরা আক্রমণে ভিটেছাড়া হতে বাধ্য হওয়া কৃষ্ণের মনে জরাসন্ধ নিধনের পরিকল্পনা দানা বেঁধেই ছিল। সেজন্য এক এক করে জরাসন্ধের অনুগতরাজাদেরইহজগৎ থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন। ইতিমধ্যে হত্যা করেছিলেন কালযবন, হংস ও ডিম্বককে। কিন্তু আরও অনেক খণ্ডরাজ্যের অধিপতিরা ছিলেন জরাসন্ধের অনুগত। এছাড়া মগধরাজের নিজেরই একুশ অক্ষৌহিণী সেনার সুবিশাল বাহিনী ছিল। তাদের প্রতিহত না করে জরাসন্ধের সামনাসামনি হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। তাই তাকে বিনাশ করতে হলে যে পাণ্ডবদের মতো মহাবীরদের প্রয়োজন এবং তাকে যে কৌশলে হত্যা করা ছাড়া ভিন্ন পথ নেই এটা কৃষ্ণ খুব ভালোই জানতেন। অথচ ধর্মরাজ হিসেবে খ্যাতিমান যুধিষ্ঠিরকে সেপথে নামানো যে খুব সহজ নয় তাও তার অজানা ছিল না। তাই তার রাজচক্রবর্তী সম্রাট হওয়ার আকাঙ্ক্ষা উস্কে দিয়ে বললেন, ‘জরাসন্ধের ভয়ে এক সময় আমি নিজে রৈবতক পর্বতের এক দুর্গম স্থানে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন অন্ধক আর বৃষ্ণিরা আমার সঙ্গে আছেন, আছেন আঠেরো হাজার আত্মীয় পরিজন। আর আপনারা তো আছেনই। জরাসন্ধকে সরাতে না পারলে আপনার রাজসূয় যজ্ঞ সম্ভব হবে না। একে তিনি নিজে প্রভূত বলশালী। তার ওপর তার অধীনে রয়েছেন ছিয়াশিজন অনুগত রাজা। কেবলমাত্র চোদ্দজন তার অনুগত নন। এমতাবস্থায় জরাসন্ধকে সম্মুখ সমরে পরাস্ত ও নিধন করা অসম্ভব। শুনে যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞের সংকল্প ত্যাগ করতে চাইলেন। কৃষ্ণ এটাই চাইছিলেন। এবার তাকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বললেন, সেকি মহারাজ! স্বয়ং দেবর্ষি আপনাকে তা করতে বলেছেন। এতে স্বয়ং দেবতাদেরও আশীর্বাদ আছে। জানবেন। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। জরাসন্ধকে আমরা গুপ্ত উপায়ে। সরিয়ে দেব। যুধিষ্ঠির কোনো কথা না বলে মৌন রইলেন। আর এভাবে তার সম্মতি আদায় করে নিলেন কৃষ্ণ। এর পরের ঘটনা, কৃষ্ণ ভীমকে দিয়ে গুপ্তপথ তৈরি করিয়ে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে জরাসন্ধের সামনে উপস্থিত হয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন এবং কৌশল অবলম্বন করে ভীমকে দিয়ে তাকে বধ করালেন। জরাসন্ধের মতো পরাক্রমীর এহেন পরিণতিতে তার পুত্রসহ ছিয়াশিজন রাজা যুধিষ্ঠিরের অধীনতা মেনে নিতে স্বীকৃত হলেন। জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবের রাজসূয় যজ্ঞের পথে আর কোনো বড়ো প্রতিবন্ধকতা রইল না। জরাসন্ধ নিধনে প্রায় নিষ্কণ্টক কৃষ্ণের পরামর্শে পাণ্ডবরা নির্গত হলেন দিগ্বিজয়ে। কে কোনদিকে যাবেন, বিভিন্ন রাজাদের শক্তি-সামর্থ্যের তুল্যমূল্য বিচার করে সেটাও ঠিক করে দিলেন কৃষ্ণ। তার পরামর্শ শিরোধার্য করে অর্জুন উত্তরে কাশ্মীর, লোহিতদেশ, ত্রিগর্ত, সিংহপুর, হরিবর্ষ, গন্ধর্ব, কম্বোজ, কুলিন্দ, আনর্ত, শালদ্বীপ ইত্যাদি জয় করে গেলেন উত্তর-পূর্বের প্ৰাগজ্যোতিষপুরে। পরে কৃষ্ণ নিজে কামরূপের রাজা নরকাসুরকে বধ করে ষোলো হাজার রমণীকে উদ্ধার করেন। পরাজিত করেন শোণিতপুরের রাজা বাণকেও। এইভাবে উত্তর এবং পূর্বোত্তর ভারতকে বস্তুত এক ছাতার তলায় নিয়ে আসেন কৃষ্ণ। মধ্যম পাণ্ডব ভীম পাঞ্চাল, বিদেহ, চেদি, অযোধ্যা, পুণ্ড্র, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি জয় করেন। মৎস্য, অবন্তি, ভোজকট, কিস্কিন্ধ্যা, মহীষ্মতি, দ্রাবিড়, কেরল, লঙ্কা, অন্ধ্র ও কলিঙ্গ রাজাদের পরাস্ত করেন সহদেব। আর নকুল জয় করেন মালব, মদ্র, দ্বারকার মূল ভূখণ্ডের নরপতিদের(শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরী ছিল মূল ভূ-খণ্ড থেকে যোজনখানেক দূরে সমুদ্রবেষ্টিত একটি দ্বীপে)। অর্থাৎ উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম সমগ্র ভারতবর্ষের খরাজ্যগুলোকে এক ছত্রতলে নিয়ে এসে এক সঙ্ঘবদ্ধ রাষ্ট্রের রূপকার হন কৃষ্ণ।
শুরু হলো যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ। সমস্ত রাজা এমনকী কৌরবরাও এসে উপস্থিত হলেন। সম্মিলিত হলো গোটা ভারত। আপাতদৃষ্টিতে তার মধ্যমণি যুধিষ্ঠির। কিন্তু প্রকৃত ছত্রপতি কে তা নিশ্চিত করতে ভুল করলেন না জ্ঞানবৃদ্ধ ভীষ্ম। সম্মিলিত মহাভারতের এই মহাযজ্ঞে কে ভূষিত হবেন পুরুষোত্তম? সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষের স্বীকৃতি লাভ করবেন কে?পিতামহ জানেন যুধিষ্ঠিরের রাজচক্রবর্তী হওয়ার পিছনে আসল মস্তিষ্ক, প্রধান কারিগর কৃষ্ণ। তার ছত্রছায়া ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। তাই এতটুকু দ্বিধা না করে যুধিষ্ঠিরকে বললেন—তেজ, বল, পরাক্রম ও দূরদর্শিতায় ব্রিফিকুলসম্ভব বাসুদেবেই শ্রেষ্ঠ। তাকেই তুমি অর্ঘ্য সম্প্রদান কর। সেইমতো কৃষ্ণকে যজ্ঞার্ঘ্য নিবেদন করলেন সহদেব। অর্থাৎ রাজার রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো কৃষ্ণকে। কিন্তু কৃষ্ণের এই মর্যাদা বরদাস্ত না করতে পেরে বিরুদ্ধাচরণ করলেন চেদিরাজ শিশুপাল। তিনি এর আগে নিরানব্বইবার কৃষ্ণকে নিন্দামন্দ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, বয়োবৃদ্ধ হিসাবে বসুদেব এই সম্মান পেতে পারেন কিন্তু বাসুদেব নন। পেতে পারেন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, আচার্য হিসেবে অস্ত্রগুরু দ্রোণ। পুরোহিত হিসেবে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসদেব কিংবা পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্মকেও এই সম্মান প্রদান করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে দুর্যোধনকে রাজেন্দ্র’অভিহিত করে তার নাম করতেও দ্বিধা করলেন না। শিশুপালের এই মতিভ্রম দেখে ভীষ্ম তাকে নিরস্ত করা এবং সেইসঙ্গে। সবাইকে শুনিয়ে বললেন,
‘অস্যাং হি সমিতৌ রাজ্ঞামেকমপ্যজিতং যুধি।
ন পশ্যামি মহীপালং সাত্বতীপুত্ৰতেজসা॥
এই সভায় আমি তো কৃষ্ণের চাইতে অধিক তেজ ও পরাক্রমী কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। এখানে এমন একজন রাজাকেও দেখছি না যিনি কৃষ্ণের কাছে পরাজিত হননি। কৃষ্ণের দৈহিক শক্তির অনন্যসাধারণ বর্ণনা ছাড়াও পারমার্থিক দিক নিয়েও পর্যালোচনা করলেন ভীষ্ম এবং তাঁকে স্বয়ং ‘ঋষিকেশ’ বলে অভিহিত করলেন। বললেন, কৃষ্ণের পূজাতেই সকলের পূজা সম্পন্ন হয়। কৃষ্ণই হলেন ভারতাত্মার সনাতন পরামাত্মা। অতঃপর সুদর্শন চক্রে শিশুপালের মুণ্ডচ্ছেদের বর্ণনার কথা সর্ববিদিত।
কৃষ্ণের রাজনীতির গভীরতা বুঝতে হলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং তার পেক্ষাপট একান্তভাবে প্রতিপাদ্য। শকুনির চালে দূত ক্রীড়ার নামে জুয়াখেলায় সর্বস্বান্ত হয়ে বনবাসে যেতে হয় পাণ্ডবদের। কৃষ্ণ সেসময় শান্বনগরের রাজা শৌভের সঙ্গে যুদ্ধরত ছিলেন। নাহলে তিনি হয়তো শকুনির চাল থেকে যুধিষ্ঠিরকে বিরত রাখতে পারতেন। কিন্তু তখন পাণ্ডবদের মাথার ওপর থেকে সেই ছাতাটা খানিকটা দূরে থাকার জন্য পাণ্ডবদের এই লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। চোদ্দ বছরের বনবাস এবং এক বছরের অজ্ঞাতবাস শেষ হতে না হতেই কীভাবে হস্তিনাপুর দখল করা যায় তা নিয়ে মন্ত্রণা শুরু হলো বিরাট রাজার সভায়। কৃষ্ণ প্রস্তাব দিলেন অর্ধেক রাজত্বের দাবি নিয়ে হস্তিনাপুরে দূত পাঠানো হোক।তার কথামতো বিরাট রাজার পুরোহিতকে দূত হিসেবে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাঠানো হলো। কিন্তু সেই সঙ্গে বাসুদেব ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য সম্মুখ সমরের প্রয়োজন হতে পারে ইঙ্গিত দিয়ে পাণ্ডবদের যুদ্ধেরও প্রস্তুতি নিতে বললেন। বিরাট রাজার পুরোহিত প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে এলেন। তবুও কিন্তু নিজেদের থেকে আক্রমণের রাস্তায় না গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে অধিকার আদায়ের একটা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা করলেন যাতে অন্যান্যরা দুর্যোধনের দম্ভের পরিচয় আরও স্পষ্টভাবে লাভ করতে পারেন। সেই আলোচনায় দৌত্যের ভার নিলেন নিজের কঁাধে এবং উপপ্লব্য থেকে হস্তিনাপুরে গেলেন। এর ঠিক আগের দিন একটা ঘটনা ঘটে। উপপ্লব্যে কৃষ্ণ এবং অর্জুন যুদ্ধায়োজনের বিষয়ে আলোচনা করছেন এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন সঞ্জয়। পাণ্ডবদের দূত হিসেবে কৃষ্ণের বক্তব্যকে কৌরবরা যাতে উপযুক্ত গুরুত্ব দেন সেজন্য সঞ্জয়কে কৃষ্ণ বললেন, ধৃতরাষ্ট্রকে গিয়ে বলো প্রিয়জনদের সঙ্গে কয়েকটা দিন আনন্দ করে নিতে। তিনি যদি মনে করে থাকেন অর্জনের মতো মহারথীকে পরাজিত করবেন তাহলে সেটা হবেতার দুরাশা। এরকম আশা করা মানে ধৃতরাষ্ট্র কালগ্রাসে পতিত হয়েছেন। এটা কূটনীতির চতুরঙ্গের এক রঙ্গ দম বা দমননীতি মানে হুশিয়ারি দেওয়া। কৃষ্ণের এটা জানাই ছিল যে ধৃতরাষ্ট্র চাইলেও দুর্যোধনকে তিনি বশে আনতে পারবেন না। সেকারণেই পাণ্ডবদের অনেক আগে থাকতেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন।
মহাভারতের উদ্যোগ এবং শল্য উভয় পর্ব থেকেই জানা যায় যে সুর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পরেই উপপ্লব্য থেকে যাত্রা করে পথিমধ্যে ব্রকস্থলে একদিন বিশ্রাম করেন কৃষ্ণ। পরদিন হস্তিনাপুরে উপস্থিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজত্ব দিয়ে দিতে বলেন। বেঁকে বসেন দুর্যোধন। চরম ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে জানিয়ে দেন কৃষ্ণের এই প্রস্তাব মানতে তারা রাজি নন। অনেক টালবাহানার পর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে বারণাবত, কুশস্থল, অবিস্থল, ব্রকস্থল এবং মাকণ্ডী— এই পাঁচখানা গ্রাম ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবরাখেন কৃষ্ণ। কিন্তু দুর্যোধন সে প্রস্তাবও নস্যাৎ করে সুঁচের ডগায় যেটুকু মাটি ওঠে পাণ্ডবদের সেটুকুও দেবেন না বলে দর্প প্রকাশ করেন। কৃষ্ণের সঙ্গে অভব্য আচরণও করা হয়। সেকারণে বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণ দুর্যোধনের আতিথেয়তা গ্রহণ না করে চলে যান বিদুরের গৃহে। হস্তিনাপুর থেকে তিনি যখন ফের উপপ্লব্যের পথে রওনা দেন তখন কর্ণও তার সঙ্গে কিছুদূর পর্যন্ত আসেন। পথে কৃষ্ণ তাকে বলেন, এখন আর যুদ্ধ ছাড়া অন্য পথ রইল না। অতএব, কর্ণ যেন দুর্যোধনকে সেজন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।
ফিরে এসে পাণ্ডবদের সবকথা জানিয়ে কৃষ্ণ বলেন, সাম, দম, দণ্ড, ভেদ— সব নীতিই প্রয়োগ করেছি কিন্তু যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়। আরও বলেন, আমরা সংখ্যায় কম হলেও কাপুরুষ নই, ক্লীব নই। ক্ষত্রিয় বীরের কাছে যুদ্ধে মৃত্যু মানে বীরগতি লাভ করা। কুরুক্ষেত্র রণাঙ্গণে যুদ্ধের ঠিক প্রাককালে বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকেও ঠিক এভাবেই উজ্জীবিত করে। বলেছিলেন—
‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ব্যুপদ্যতে।
ক্ষুদ্র হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্কোত্তিষ্ঠ পরন্তপ॥’
ক্ষত্রিয়ের ক্লীবতাকে নপুংশকতা বলে কটাক্ষ করেছিলেন।
কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে কৃষ্ণ নিজে যুদ্ধ করেননি। ছিলেন অর্জুনের সারথি। কিন্তু অযুধ্যমান থেকেও তিনিই ছিলেন প্রকৃত নিয়ন্তা। তার কৌশলে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, জয়দ্রথ প্রমুখ এমনকী দুর্যোধনসহ কৌরব পক্ষের যাবতীয় শূরবীরেরা একে একে ধরাশায়ী হন। একচ্ছত্র সম্রাট হন যুধিষ্ঠির। মহাভারতের সাধারণ জ্ঞান রাখা কোনো মানুষের কাছে এসব কথা বিস্তারিতভাবে বলার প্রয়োজন নেই। যেকথা পুনরায় উচ্চারণ না করলে নয় তাহলো, ওই মহাযুদ্ধের পর সারা ভারত কৃষ্ণের ছত্রছায়ায় চলে আসে। অবন্তী, মৎস্য, অটবী, বহুধান্য, উত্তরজ্যোতিষ, ত্রিপুরা, আভির, চক্র, মিথিলা, বিদেহ, ভোজ, ইত্যাদি সমস্ত খণ্ডরাজ্য যুদ্ধিষ্ঠিরের অধীনতা স্বীকার করে।
এই সাফল্যের প্রতিভূ রূপে পাণ্ডবরা থাকলেও সমস্ত রাজারাই ‘রাজার রাজা’বলে মেনে নেন দ্বারকাধীশকে। যুধিষ্ঠির একছত্র সম্রাটহলেও সেই ছত্রের প্রধানাধিপতি আর কেউ নন, তিনি ভগবানের বিভূতিস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ। তিনিই মহাভারতের ছত্রপতি।
দুর্গাপদ ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.