বিশ্বের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে পেঁচাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে লক্ষ্মীর বাহন কল্পনার মধ্যে দিয়ে। এককালে পেঁচাই ছিল দেবীর প্রতীক। কীভাবে পেঁচা থেকে মানবী মূর্তির আবির্ভাব হল সে এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ইতিহাস।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা পক্ষীবিশারদও ছিলেন। লক্ষ্মীর বাহন কল্পনাতে তার নিদর্শন রেখেছেন। লক্ষ্মীর স্বভাব বৈশিষ্ট্য অনুসারে তার বাহন চিহ্নিত করেছেন। “প্যাঁচায় চড়ে লক্ষ্মী আসেন ঘরে, ভূত পালায় ডরে।/লক্ষ্মীর হাতে ধানের বালা মাথায় সোনার ছাতি।/ভূত পালালো, জ্বালা তোরা হাজার সোনার বাতি।” (‘ভূত তাড়ানোর মন্ত্র, উপন্যাস ‘রায়বাড়ী’, গিরিবালা দেবী, ১৯৭৪)
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী পেঁচা অতিলৌকিক জগতের প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা; শ্মশান জাগানো তন্ত্রোপাসনার সে নীরব সাক্ষী। সে নিশাচর, জীবন-জীবিকার সন্ধানে রাতের অন্ধকারে তার নিঃশব্দ পক্ষচারণা। এমন প্রাণীটিকে যিনি বাহন নির্বাচন করেছেন তিনি ভূত তাড়ানোর মন্ত্রেও থাকবেন এতে আশ্চর্য কী?
লক্ষ্মীকে রাতেই যাত্রা করতে হয় কেন? কেননা পেঁচা স্বভাবে nocturnal, বাহন হিসাবে পেতে হলে রাতেই তাঁকে স্থানান্তর যাত্রা করতে হবে। অন্য কোন উপায় নেই।
পেঁচার খাদ্যতালিকায় ইঁদুরের স্থান সর্বাগ্রে, তারপর ক্ষেতের অন্যান্য কীটপতঙ্গ। ধানের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রাণীটি হচ্ছে ইঁদুর। ইঁদুর ভক্ষণ করে পেঁচা অনেককাল আগে কৃষিজীবী মানুষের মন জয় করেছিল। শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু — এই নীতিতে পেঁচা একসময় জুমর্ফিক বা প্রাণীদেহী দেবতায় উন্নীত হল। বহু শ্রমের ফসল ধান; তার জন্যে মানুষের ঘাম-রক্তের কার্পণ্য নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যে ক্ষেত-খামারেই তার দিনাতিপাত। কিন্তু রাতে ফসল পাহারা দেবে কে? প্রয়োজন ঘটল নৈশ প্রহরীর। তিনি পক্ষী-স্বরূপা-পেঁচা। অনেক অনেক দিন বাদে সেই পক্ষীদেবতাই মানুষের মনোভূমিতে মানবীয় অবয়ব পেল। তিনিই আজকের লক্ষ্মী।