কেটে গিয়েছে এক বছরেরও বেশি সময়। তবে আতঙ্ক কাটেনি করোনার। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বরং বেড়েই চলেছে কোভিড ১৯-এর প্রকোপ। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ঠিক কী করণীয়? কোভিড ১৯-এর দ্বিতীয় ওয়েভ নিয়ে আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে আলোচনায় ঢাকুরিয়া আমরির, সংক্রামক রোগ বিভাগের পরামর্শদাতা, চিকিৎসক সায়ন চক্রবর্তী।
প্রথম ওয়েভ শেষ করে ফের হানা দিয়েছে কোভিডের দ্বিতীয় ওয়েভ। এবং বলা হচ্ছে আগের থেকে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস। কেন? এতটা দ্রুত ছড়ানোর কারণটাই বা কী?
আসলে এর পিছনে দুটো কারণ রয়েছে। প্রথমত, ভাইরাসের মিউটেশন। ভাইরাসের চরিত্র বদলের ফলেই মূলত এটিকে এত বেশি ভয়ংকর দেখাচ্ছে। যে কারণে ইনফেকশন রেটও অনেকটাই বেশি। দ্বিতীয়ত, মানুষের গাফিলতি। বার বার বলা সত্ত্বেও বহু মানুষ ঠিকভাবে মাস্ক পরছে না, হাইজিন মেনে চলছে না। প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বাইরে বের হচ্ছে। যে কারণে এতটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস।
Advertisement
Advertisement
কোভিডের এই দ্বিতীয় ওয়েভে মূল উপসর্গগুলি কী কী দেখা যাচ্ছে?
কোভিডের প্রথম ওয়েভের মতো, দ্বিতীয় ওয়েভেও সর্দি, জ্বর, গায়ে ব্যথা, গলা ব্যথা, গন্ধ না পাওয়ার মতো বিষয়গুলি রয়েছে। তবে এই পর্যায়ে আরও দু’টি নতুন উপসর্গ দেখা গিয়েছে। যেগুলি হল ডায়েরিয়া এবং গায়ে র্যাশ।
এরই পাশাপাশি হোম আইসোলেশন নিয়ে আরও একটা জিনিস আমি বলতে চাই। উপরের কোনও উপসর্গ দেখা গেলেই আগেভাগে নিজেকে আলাদা করে নিতে হবে। টেস্ট রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করলে কিন্তু চলবে না। নয়তো ওই ব্যক্তি অজান্তেই পরিবারের অন্য সদস্য সংক্রামিত করতে পারেন। আর আলাদা থাকা মানে ওই ব্যক্তি যেন অন্য কারোর সংস্পর্শে না আসেন। তার জন্য আলাদা বাথরুম, আলাদা ঘর অত্যন্ত জরুরি।
এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কী কী প্রোটোকল মেনে চলার পরামর্শ দেবেন আপনি?
মাস্ক পরাটা কিন্তু অত্যন্ত জরুরি। শুধু পরাই নয়, সঠিক পদ্ধতিতে মাস্ক পরাটা জরুরি। মাস্ক কানের পাশে ঝুলে রইল, কিংবা থুঁতনির নীচে রইল, নাক না ঢেকে শুধু মুখের উপর মাস্ক পরে নিলাম – এমনটা করলে কিন্তু চলবে না। মাস্ক এমন ভাবে পরতে হবে যাতে আপনার মুখ ও নাক ভাল ভাবে ঢাকা থাকে। সেই সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বাইরে থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবহার এবং ঘরে ফিরে এসে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
অন্যদিকে ভ্যাকসিনেশন কিন্তু অত্যন্ত জরুরি। যাদের ভ্যাকসিনেশন হয়নি, তাদের এই মুহূর্তে সব পদ্ধতি মেনে ভ্যাকসিন নেওয়া উচিৎ। এই তিনটে জিনিস মেনে চললেই আমরা কোভিডের হাত থেকে রেহাই পেতে পারি।
এমন অনেকগুলি ঘটনা রয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, ভ্যাকসিনেশনের পরেও অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। এই বিষয়টি আপনি কী ভাবে ব্যখ্যা করবেন?
এই মুহূর্তে ভারতের হাতে দু’টি ভ্যাকসিন রয়েছে – কোভিশিল্ড এবং কোভ্যাকসিন। এদের সামগ্রিক কার্যকারিতা গড়ে ৬৫ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ। কয়েকদিন আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো একটি পরিসংখ্যান দেয়। সেই পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে ভ্যাকসিনেশন পরবর্তী ইনফেকশনের সংখ্যাটা মাত্র ০.০৪ শতাংশ। যেটা খুবই কম। অন্যদিকে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস কিন্তু মারাত্মক আকার নিতে পারেনি, দু’-একটি ঘটনা ছাড়া। সেই কারণেই প্রত্যেককে বার বার করে ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য আবেদন করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ল্যানসেটের রিপোর্টে বলা হয়েছে করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত। সত্যিই কি তাই? আর যদি তা হয়ই, তবে তো ঘরে বা বাইরে কোনও জায়গাতেই রেহাই নেই।
প্রথমেই বলে দি, ল্যানসেটের তরফে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছিল সেটির অনেকটাই কিন্তু মতামত ভিত্তিক, গবেষণা ভিত্তিক নয়। ইনফেকশনের কারণ হিসেবে ওই প্রতিবেদনে অনেকগুলি পয়েন্টই রয়েছে। যার ভিত্তিতে একটি মতামত দিয়েছে তারা। আদৌ করোনা বাহুবাহিত কিনা সে কথা জানার জন্য দীর্ঘ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এমনকী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বা কোনও সরকারি প্রতিবেদনেও এখনও পর্যন্ত একথা বলা নেই। তবে হ্যাঁ, যদি প্রমাণিত হয় যে এই ভাইরাস বায়ুবাহিত, তা হলে আরও সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। কাপড়ের ফ্যান্সি মাস্ক হয়, বায়ুবাহিত রোগ থেকে বাঁচতে কিন্তু প্রয়োজন এন৯৫ মাস্ক।
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কোভিড থেকে বাঁচতে আগেভাগেই অনেকে ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, জিঙ্কের মতো সাপ্লিমেন্ট নিচ্ছেন। এটা কতটা সঠিক?
এটা একদমই ভুল। কোনও ধরনের সাপ্লিমেন্টই আদতে কোভিডের হাত থেকে আপনাকে বাঁচাতে পারে না। ভাল পুষ্টিযু্ক্ত খাদ্য, হাই প্রোটিন ডায়েট ইত্যাদি আপনিই খেতেই পারেন। তবে এই ধরনের সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার পরে আপনি যদি মনে করেন, আপনি বিপন্মুক্ত, তা হলে আপনি সেটা ভুল ভাবছেন এবং অবহেলার কারণে সংক্রামণের আশঙ্কা বাড়াচ্ছেন। করোনা থেকে বাঁচতে বেসিক প্রোটোকলগুলি আপনাকে মেনে চলতেই হবে। মাস্ক পরুন, দূরত্ব বজায় রাখুন, এবং অবশ্যই ভ্যাকসিন নিন।
এই মুহূর্তের করোনা থেকে বাঁচতে কী কী পদক্ষেপ করেছে আমরি?
এই অতিমারির মধ্যে দাঁড়িয়েও আমরির অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং অপারেশন টিম প্রতিনিয়ত বেশ ভালই কাজ করে চলেছে। প্রত্যেক রোগীর যাতে অক্সিজেন সাপ্লাই ঠিকমতো থাকে, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বেড নিয়ে একটু সমস্যা তো হচ্ছেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি কী ভাবে বেডের সংখ্যা আরও বাড়ানো যায়।
পাশাপাশি যে সমস্ত রোগীদের অল্প উপসর্গ রয়েছে বা কোনও উপসর্গ নেই এবং বাড়িতে যাদের একা থাকা সম্ভবপর হচ্ছে না, কিংবা দেখাশোনার কেউ নেই, তাদের জন্য কলকাতার সাদার্ন অ্যাভেনিউতে একটি স্যাটেলাইট সেন্টার চালু করেছে আমরি। এই সমস্ত রোগীরা চাইলে পরীক্ষা করে ওই সেন্টারে গিয়ে থাকতে পারেন। যেখানে আমাদের চিকিৎসকেরা তাদের দেখাশোনা করবেন। নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলি করবেন।
সম্প্রতি ইন্টারনেট বা হোয়াটস অ্যাপে বার বার প্লাজমা ডোনেশনের বিভিন্ন কনটেন্ট দেখা যাচ্ছে। কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে প্লাজমা থেরাপি কতটা কার্যকরী বলে আপনি মনে করেন?
সত্যি বলতে অনেকই এই মুহূর্তে কোভিড জয় করে ফেরা ব্যক্তিদের প্লাজমা সংরক্ষণের উপর জোর দিচ্ছেন। তাঁদের প্লাজমা ডোনেট করার উৎসাহ যোগাচ্ছেন অনেকে। তবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলতে গেলে এই প্লাজমা থেরাপি কিন্তু ততটাও কার্যকরী নয়। বলতে গেলে ততটা জীবনদায়ীও নয়। তবে হ্যাঁ, যদি সমস্ত প্রচেষ্টা শেষ হয়ে যায়, তখন অবশ্যই এই থেরাপি ব্যবহার করা যায় শেষ চেষ্টা হিসেবে। কিন্তু সমস্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান বলছে এই থেরাপি ততটাও কার্যকরী নয়।
জরুরি অবস্থায় কল করুন ২৪x৭ হেল্পলাইন নম্বরে – (০৩৩) ৬৬৮০ ০০০০